কোচিং না করে ও খারাপ জিপিএ নিয়েও বিসিএস পাওয়া সম্ভব!

লেখক: মোজাহিদুল ইসলাম

2015 এর শুরুর দিকে চাকরির বাজারে ঢুকেছি। একাডেমিক পড়াশোনা আরও আগে শেষ হলেও আমার নিজের একটা কোচিং সেন্টার ছিল। এর পেছনে দিনরাত সময় দিয়ে চাকরির পড়াশোনা আর করতে মন চাইত না। তার উপর আমি চরম অলস প্রকৃতির। ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবা শুরু করেছি যখন চাকরির বয়স দুই থেকে আড়াই বছর বাকি । ভেবেছিলাম দু’বছর চেষ্টা করলে একটা প্রথম শ্রেণীর চাকরি হয়ে যাবে। এর মধ্যেই এক ফ্রেন্ড এই গ্রুপটার কথা বলল। তখনো বিসিএস দেব সেটা মাথায় ছিল না। বিসিএসের আগামাথা কিছুই বুঝতাম না। নতুনদের সবাই বোধয় এই সময়টা পার করে।

বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ড এর ছাত্র হওয়ায় কেন যেন ব্যাংকের প্রতি চরম আগ্রহ কাজ করত। আর বিসিএস এর সিলেবাস দেখে বুঝলাম বিসিএস আমাকে দিয়ে হবে না। ব্যাংকের পড়াশোনাতেই বরং একটু ফাকি দেয়া যাবে। কারণ কোচিংয়ে ম্যাথ আর ইংরেজি বেশি পড়াতাম। যাইহোক ব্যাংকে পরীক্ষা দিয়েই বুঝলাম, আমি যতটা সহজ ভেবেছি, চাকরির বাজারটা তার চেয়ে ঢের বেশি প্রতিযোগিতামূলক। এখানে টিকে থাকতে হলে শুধু চাকরির পড়াশোনাতেই কনসানট্রেট করতে হবে। কিন্তু সে সুযোগ ছিল না কারণ তার কয়েক বছর আগেই বাবা রিটায়ার্ড করায় ফ্যামিলিকেও ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দেয়া খুব দরকার ছিল। আর বেকার কখনো থাকতে হয় নি বলে চাকরির জন্য যে তীব্র তৃষ্ণা কাজ করে অনেকের তাও ছিল না। এখন মনে হয়, বেকারত্বও অনেকের জন্য আশীর্বাদ।

যা হোক, প্রথম পাঁচটি প্রথম শ্রেণির চাকরির প্রিলি/এমসিকিউতে পাস করেছিলাম। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ে, সোনালী, জনতার দুইটা পদে, আর ৩৫তম বিসিএসে। খুব খুশিতে এই গ্রুপে (বিসিএস আওয়ার গোল) একটা পোস্ট দিলাম (সম্ভবত আমার প্রথম পোস্ট ছিল ‘বিসিএস আওয়ার গোল’-এ ) । অনেকে বাজে মন্তব্য করল। কোটা আছে, প্রশ্ন পেয়েছি, মিথ্যে বলছি আরো অনেক কথা।

কিন্তু বিসিএস আওয়ার গ্রুপের এডমিন Espat Manob ভাই বলেছিলেন
“আপনাকে ক্যাডার হিসেবে দেখতে চাই”
বাকিসব খারাপ মন্তব্য কানে দেই নি শুধু ওনার কথাটা মনে রেখে দিয়েছি।

কিন্তু কিভাবে বিসিএস দেব, কি পড়ব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। কনফিডেন্স কোচিংয়ে গেলাম। 7000 টাকা পে করলাম, বোধয় সব মিলিয়ে এক সপ্তাহ ক্লাস করেছি, রাজু ভাইয়ের এত পিড়াপিড়ি, অ্যাসাইনমেন্ট দেখে দ্বিতীয়বার মনে হল যারা বিসিএস দেয় ওরা অন্য গ্রহের মানুষ। একটা চাকুরির জন্য মানুষ এত সিরিয়াস হতে পারে জানা ছিল না। (বলে রাখি, কোচিংয়ের একমাত্র অ্যাসাইনমেন্ট আব্বু করে দিয়েছিল)

তারপর দু’বার ফাইন দিয়ে কানে ধরলাম, জীবনেও আর কোচিংয়ের নাম ধরব না।

এর মধ্যে সুশান্ত দাদার একটা ক্যারিয়ার আড্ডা হল চট্টগ্রাম মুসলিম হলে। ছোটবোনসহ গেলাম। দেখলাম ওনিও আমার মতই, বিসিএসে প্রথম হওয়া মানুষ দেখতে অন্যরকম হবে এমন ধারনা ভুল প্রমাণিত হল। এবার সাহস পেলাম, না, আমিও পারব।

বই কিনলাম প্রিলির, উদ্যম যেটা কারিয়ার আড্ডায় পেয়েছিলাম তা বই কিনতে কিনতেই শেষ। কি পড়ব, কোনটা পড়ব বুঝতে বুঝতেই পরীক্ষা চলে এল। পড়া যা পড়ার দরকার ছিল তার 5%ও হয়নি। কিন্তু ভাগ্য ভাল যে ৩৫ এর প্রশ্ন বই থেকে খুব কমন আসে নি। তাই কোচিং যারা করেছে তারা খুব একটা এগিয়ে ছিল না। সাহস করে দাগিয়ে আসলাম, প্রিলি পাস করলাম।
তারপর কিভাবে যেন কনফিডেন্স বেড়ে গেল। এবার আর ছাড় নয়। সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে। কোচিং করতে চাইলাম কিন্তু এর মধ্যে আমার প্রথম শ্রেণির একটা চাকরি হয়ে গেল (শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে )। এবারো কোচিং কপালে জুটল না।

তারপর চাকরিতে যোগদান করলাম। শুরুতেই ট্রেইনিং ছিল নায়েমে। সেখানে পরিচিত হই কয়েকজন ক্যাডারের সাথে (শিক্ষা) যাদের ফাউন্ডেশন কোর্স ছিল। উনাদের সাথে কথা বলে আরেকটু সাহস পেলাম।

তারপর রিটেনের বই কিনি এক সেট। ফেসবুকে একটা গ্রুপও করি যেখানে এখন প্রায় 25,000 মেম্বার। তখনো পড়াশোনা গ্রুপে বিভিন্ন পোস্ট, ফাইল শেয়ারে সীমাবদ্ধ ছিল।

দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। পড়াশোনা শুরু করব। এমন সময় আব্বু খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ক্যান্সার ধরা পড়ল। পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সব আমার দেখাশোনা করতে হয়েছে। চট্টগ্রামে অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি। করাইনি এমন কোন টেস্ট বোধয় বাদ ছিল না। কিন্তু ওনাদের ট্রিটমেন্ট একেকরকম হওয়ায় ঢাকা ক্যানসার হসপিটালে নিয়ে গেলাম। বেশ কিছুদিন ট্রিটমেন্ট চলল। ভাবলাম রিটেন আর দেয়া হবে না। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ক্যামোথেরাপি দেয়ার আগেই ঔষধসেবনেই রোগ (CLL, a type of blood cancer) নিয়ন্ত্রণে এল। চট্টগ্রাম ফিরলাম অগাস্ট এর দুই তারিখ। পরের মাসের এক তারিখ রিটেন।

কর্মস্থলে চলে গেলাম বইপুস্তক নিয়ে। তারপর শুরু করলাম পড়াশোনা। অফিসের কর্মচারীরা যথেষ্ট হেল্প করল। আমার অল্প কিছু কাজ ছাড়া প্রায় সব কাজ ওনারাই করে দিয়েছেন। তাই দিনে 15- 16 ঘন্টা করে পড়াশোনা করতে লাগলাম। ইংরেজি আর গণিতে খুব সময় দিতে হয়নি কারণ দীর্ঘ সময় কোচিংয়ে পড়িয়েছি (অনেকের এই দুই বিষয়ে সময় দিতে হয় যা আমাকে একটু এগিয়ে রেখেছে)। বাকি বিষয়গুলো পড়তে লাগলাম ডাইজেস্ট (অ্যসিওরেন্স) ও গাইড (প্রফেসরস) মিলিয়ে। ফেসবুক থেকেও কিছু ম্যাটেরিয়েলস কালেক্ট করেছি বিশেষ করে IA ও BA এর জন্য ( Samad Azad ভাইয়ের নাম না নিলে নয়) । কিছু নোটও করলাম খুব সংক্ষেপে IA, BA ও বাংলা’র।

টানা সাতাশ আটাশ দিন একটানা পড়েছি, দিনরাত পড়েছি। রাত দুইটাই পড়েছি, তিনটায় পড়েছি। রাতে ঘুম হত না, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে পড়তে বসেছি। রাত জাগার অভ্যেস মোটেও ছিল নানা। মাথা গরম হয়ে যেত, গামছা ভিজিয়ে মাথায় দিয়েছি, দিনে দুইতিন বার মাথায় পানি দিতে হত। ঐ এক মাস কারো সাথে দশ মিনিট কথা বলার সময়ও পাইনি। কাজ বলতে নামাজ আর খাওয়াদাওয়া। সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা ছিল। উনি দেখেছেন এক মাস কিভাবে পরিশ্রম করেছি। এর প্রতিদান নিশ্চয়ই তিনি দিবেন।

রিটেন পাশ করলাম। ভাইভা দিলাম। ক্যাডার চয়েস একটাই ছিল (প্রফেশনালে দিয়েছি, শিক্ষক পরিবার, বাবার পছন্দ, আর প্রায় দশ বছর স্টুডেন্টও পড়িয়েছি, মনে হয়েছে, এই পেশায় সহজে মানিয়ে নিতে পারব আর এই পেশায় নিজের জন্য কিছু সময়ও রাখতে পারব, তাই সবার পরামর্শের ভিত্তিতে তৈরি ক্যাডার লিস্টে সবার শেষে এডুকেশন থাকলেও শেষ মুহূর্তে নিজের কথাই শুনেছি, শুধু প্রফেশনালে দিয়েছি)

এর মধ্যে ঐ তিন ব্যাংকের রিটেন পাস করে ভাইভা দিয়েছি। তিনটাতেই ( সোনালীর SO, জনতার EO, FINANCIAL ANALYST) ও পরবর্তীতে দেয়া বাংলাদেশ বাংকের এডিতে অশ্বডিম্ব। কনফিডেন্স তলানিতে ঠেকল। এই মাসের 14 তারিখ আমার 29তম জন্মদিন ছিল। আম্মু বাড়ি যেতে বলল, আপু ফোন দিল। অফডেতেও বাড়ি গেলাম না। রেজাল্ট পজিটিভ না হলে বাড়িতেই যাব না, এমন একটা জেদ কাজ করছিল। তিনদিন পরই হঠাৎ দেখি রেজাল্ট দিল। নিজের রোলটা রেখে সোজা দুই রাকাত নামাজ আদায় করলাম, নামাজে কেন যেন দু’চোখ ভিজিয়ে কেঁদেছি। তারপর বাসায় রেজাল্ট জানালাম। রিটেন দেয়া কতটা কষ্টের সেটা প্রতিটা ক্যাডার জানেন। সৃষ্টিকর্তা আমার প্রথম প্রচেষ্টাকে পুরস্কৃত করেছেন যার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কোনভাবেই সম্ভব নয়।

সৃষ্টিকর্তা, বাবা-মা, এই গ্রুপ ( বিসিএস আওয়ার গোল), অফিসের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।
কিছু কথা:
১। পুরোপুরি ফেয়ারলি নিয়োগ বিসিএসেই হয়। নিশ্চিন্তে পড়তে থাকুন।
২। আমার এসএসসিতে (2003) জিপিএ কম, খুব কম ছিল। সম্ভবত এবার ক্যাডার যারা হয়েছেন তাদের মধ্যে সর্বনিম্ন জিপিএ। আমার শিক্ষাজীবনের ট্রাজেডি ছিল। (তবে এইচএসসিতে তার প্রায় দ্বিগুণ, মানসিক দক্ষতা প্রয়োগ করে জিপিএ অনুমান করে নিন ? পরবর্তী সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণী/সমতুল্য রেজাল্ট ছিল)
৩। সিলেবাস বুঝেন, না বুঝেন, কোচিং করেন না করেন, পড়াশোনা চালিয়ে যান, পড়তে পড়তে বুঝে যাবেন।
৪। কারো পরামর্শ, উপদেশ, অনুপ্রেরণা ছাড়া বোধয় বিসিএস সম্ভব না। আশেপাশে কোন ক্যাডার থাকলে পরামর্শ নিন, আলোচনা করুন।
৫। কারো কথায় কান দিবেন না, সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রাখুন, তিনি কখনো অবিচার করবেন না। আপনাকে পুরস্কৃত করবেনই, কখন করবেন তা তিনিই ভাল জানেন।

দেশের জন্য আরো বৃহত্তর পরিসরে অবদান রাখতে চাই। চাকরির বয়সের শেষ দিন পর্যন্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে আরো ভাল কিছু করার। দোয়া করবেন আমার জন্য।

লেখক
মোজাহিদুল ইসলাম
৩৫তম বিসিএস
(সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত)