৩৯টি মন্ত্রণালয়ে ২লাখ ৫০ হাজার শূন্যপদে নিয়োগের তাগিদ

সরকারের ৩৯টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের আওতায় আড়াই লাখেরও বেশি শূন্য পদ রয়েছে। এসব পদের বেশির ভাগই আবার মাঠপর্যায়ের। মামলাজট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাসহ বিভিন্ন কারণে বেসামরিক প্রশাসনে এই বিপুলসংখ্যক জনবল নিয়োগ আটকে আছে। জনবলের অভাবে মাঠপর্যায়ে কাজকর্মে সমস্যা হওয়ার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসকেরা।

গত মঙ্গলবার থেকে ঢাকায় শুরু হওয়া চার দিনব্যাপী সম্মেলনে শূন্য পদগুলো পূরণের প্রস্তাব করেন জেলা প্রশাসকেরা। তাঁদের অনেকেই বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে শিক্ষক না থাকায় মাঠপর্যায়ে লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। চিকিৎসক ও নার্সের অভাবে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাঘাত ঘটছে। কৃষি, ভূমি, রেলসহ সেবাসংশ্লিষ্ট জনবলে ঘাটতি থাকায় নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।

জেলা প্রশাসক সম্মেলনের ওই আলোচনার সূত্র ধরে শিক্ষা ও গণশিক্ষাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সরকারি কর্মকমিশনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সারা দেশে ক্যাডার, নন-ক্যাডার, শিক্ষক, পুলিশ, কর্মচারীসহ বিভিন্ন পদ শূন্য আছে আড়াই লাখের বেশি। বেশির ভাগ পদই পূরণ করা যাচ্ছে না মামলা থাকার কারণে। এর মধ্যে রেলওয়ে, খাদ্য, কৃষি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ ঘুরপাক খাচ্ছে মামলাজটে পড়ে। উল্লেখ্য, দেশে বেসামরিক ও সামরিক প্রশাসনে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন পাওয়া জনবল আছে প্রায় ২৩ লাখ।

শিক্ষকের অভাবে লেখাপড়া ব্যাহত: জেলা প্রশাসক সম্মেলনে হাওর ও চরাঞ্চলের স্কুলগুলোতে শিক্ষকসংকটের কথা বলেছেন সিরাজগঞ্জ ও গাইবান্ধার জেলা প্রশাসকেরা। তাঁরা আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের কথা বলেন। একই সঙ্গে তাঁদের বিশেষ ভাতা দেওয়ার সুপারিশ করেন জেলা প্রশাসকেরা।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতার কারণে সময়মতো শিক্ষক নিয়োগ ও পদায়ন করা সম্ভব হয় না। এতে ছাত্রছাত্রীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক। তিনি দুই বছরের জন্য শিক্ষক নিয়োগের প্যানেল তৈরির পরামর্শ দেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ বা বদলির ক্ষেত্রে দুর্গম অঞ্চল বিবেচনায় শিক্ষকের সংখ্যা সমন্বয় করে সমতা বিধানের সুপারিশ করেছেন কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক।

সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ওই বিভাগে শিক্ষকের শূন্য পদগুলো দ্রুত পূরণ করা প্রয়োজন বলে মত দেন। চাঁদপুর জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, জেলার সরকারি কলেজে ১৩ হাজার শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে। জনবল-কাঠামো অনুযায়ী সেখানে ১০৩টি নতুন পদ দরকার।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বলেন, জেলার পিএইচপি সেন্টার সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় ও সরকারি বাক-শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কারিগরি শিক্ষকের অভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, মন্ত্রণালয়ে শূন্য পদের সংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি। এর মধ্যে সরকারি কলেজে শূন্য আছে ২ হাজার ৩০০ পদ। এ ছাড়া সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে শূন্য পদ আছে ১ হাজার ৭৩৩টি। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মাঠপর্যায়ে প্রভাষকের পদ শূন্য থাকায় লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটছে। ৩৪, ৩৫ ও ৩৬তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ শেষ হলে শিক্ষকের ঘাটতি কমবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সহকারী শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকসহ মন্ত্রণালয়ে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য আছে। প্যানেলভুক্ত ও পুলের শিক্ষকেরা মামলা করায় ২০১৪ সালের অক্টোবরের পর থেকে স্বাভাবিক নিয়োগ বন্ধ আছে। এ জন্য মাঠপর্যায়ে লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটছে।

জেলা প্রশাসক সম্মেলন থেকে বের হওয়ার পর এক প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, রেলের নিয়োগ আটকে আছে বিএনপি-জামায়াত আমলে বেশ কিছু মামলা হওয়ার কারণে। গত সাত বছরে এই সরকারের মেয়াদে রেল মন্ত্রণালয় কী করেছে—এমন প্রশ্নের জবাবে রেলমন্ত্রী জানান, গত কয়েক বছরে আট হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি করে আগামী দুই বছরের মধ্যে সব শূন্য পদ পূরণ করা যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই মন্ত্রণালয়ের অধীনে শূন্য পদ আছে প্রায় ১২ হাজার।

হাসপাতালে জনবল-সংকট: জেলা প্রশাসক সম্মেলন সূত্র জানায়, নওগাঁ, লালমনিরহাট ও জয়পুরহাটের জেলা প্রশাসকেরা জেলাগুলোর সদর হাসপাতালে জনবল নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক বলেছেন, সেখানকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ২৫০ শয্যার করা হলেও জনবলের অভাবে এটি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা যাচ্ছে না।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক জানান, জেলার ২৫০ শয্যার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) ২০১১ সালে হস্তান্তর হলেও প্রয়োজনীয় জনবল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে চালু করা যায়নি। লক্ষ্মীপুর জেলার ৫০ শয্যার হাসপাতাল ২০০৩ সালে ১০০ শয্যার করা হলেও ৫০ শয্যা হাসপাতালের জনবল দিয়েই ১০০ শয্যার হাসপাতালটি চলছে বলে জানিয়েছেন সেখানকার জেলা প্রশাসক।

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক প্রস্তাব পাঠিয়েছেন প্রতি জেলায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল টেকনিশিয়ান ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োগ দেওয়ার জন্য। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মহানগরে প্রতিষ্ঠিত মানসিক প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানটির শূন্য পদ পূরণসহ সার্বক্ষণিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার কথা বলেছেন।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ওই মন্ত্রণালয়ে চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীর প্রায় ২৮ হাজার পদ শূন্য আছে। প্রায় ১০ হাজার নার্স নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। সম্প্রতি মন্ত্রিসভা কোটার কারণে পদ শূন্য না রেখে মেধার ভিত্তিতে নার্স নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদন করেছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের ছয় জেলায় চিকিৎসকের মোট পদের সংখ্যা ১ হাজার ৮৫, কর্মরত আছেন ৫২৩ জন। অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত নার্সদের মধ্যে কিছু চিকিৎসক ওই বিভাগের বিভিন্ন জেলায় নিয়োগ দেওয়া হলেও তাঁদের বেশির ভাগই ঢাকা এবং এর আশপাশে বদলি হয়ে চলে গেছেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়: দেশের অধিকাংশ ভূমি অফিসে কানুনগো ও সার্ভেয়ার পদ শূন্য রয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মাঠপর্যায়ে বেশির ভাগ পদ শূন্য থাকলেও মামলার কারণে নিয়োগ আটকে আছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ২৪ জুলাই জেলা প্রশাসক সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, তিনি ভূমিসচিব থাকাকালে নিয়োগ ও পদোন্নতিসংক্রান্ত ৩৮টি মামলা ছিল। এসব মামলা কমিয়ে তিনি দুটিতে কমিয়ে আনেন। ওই মন্ত্রণালয় আইনি জটিলতা শেষ করে নিয়োগ-প্রক্রিয়া চালুর চেষ্টা করে যাচ্ছে।

মন্ত্রণালয় ও বিভাগসমূহের ২০১৪-১৫ অর্থবছরের কার্যাবলি-সম্পর্কিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২২ হাজার ১৬৩, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ১৩ হাজার ৩৮৬, কৃষি মন্ত্রণালয়ের ১০ হাজার ৭২৫ এবং রেল মন্ত্রণালয়ের ১১ হাজার পদ শূন্য রয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, শূন্য পদের সংখ্যা ২ লাখ ৪৭ হাজার ৬৪৮।

শূন্য পদ পূরণে ধীরগতি: তথ্য ও পরিসংখ্যান বলছে, শূন্য পদের সংখ্যা পূরণ হচ্ছে ধীরগতিতে। ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ও বর্তমান জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার ৬৮৬।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেসামরিক প্রশাসনে ওপরের দিকে, বিশেষ করে অতিরিক্ত সচিব ও যুগ্ম সচিবের পদ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে গেছে। কিন্তু নিচের দিকে, বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অনেক পদ খালি। মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেন, ৩৫, ৩৫ ও ৩৭তম বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ শেষ হলে ক্যাডার পদে মোট ৫ হাজার ৪১০ জন কর্মকর্তা নিয়োগ পাবেন।