সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি খরচ দেখানো হয় ১৭ হাজার টাকা, দিতে হয় ১২ লাখ

ফরিদপুরের আশরাফুল ইসলাম জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান জিএমজি ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে সম্প্রতি সৌদি আরবে গেছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সব কাগজপত্রে বলা হয়েছে, ১৭ হাজার ৪০০ টাকায় তাঁকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে পাঠানো হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তাঁর খরচ হয়েছে ১১ লাখ টাকা।

আশরাফুলের বাবা কুব্বাত আলী খান প্রথম আলোকে বলেন, জমিজমা বিক্রি আর ধারদেনা করে তিনি এই টাকা জোগাড় করেছেন। সৌদি আরবে গিয়ে মাসে আশরাফুলের ১ হাজার রিয়াল (২০ হাজার টাকা) বেতন পাওয়ার কথা। বাস্তবতা হলো, তিনি এখনো কোনো কাজ পাননি। উল্টো তাঁকে আরও ৬০ হাজার টাকা বিকাশ করে পাঠাতে হয়েছে।

আশরাফুলের মতো একই ঘটনা ঘটেছে রাজবাড়ীর কবির খান, ঢাকার দোহারের কাশেম খান, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জালাল মিয়াসহ হাজারো যুবকের ক্ষেত্রে। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, সরকার সৌদি আরবে লোক পাঠানোর ক্ষেত্রে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের ১৭ হাজার ৪০০ টাকার সীমা বেঁধে দিলেও বাস্তবে ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা লাগছে। অথচ সরকারি নথিতে ১৭ হাজার ৪০০ টাকা নেওয়া হয়েছে বলে দেখানো হচ্ছে। এর মধ্যে গত আগস্ট থেকে সেই খরচ ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলেও এখনো এর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।

সরকার নির্ধারিত ১৭ হাজার ৪০০ টাকা যৌক্তিক খরচ হয়ে থাকলে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কেন লাগছে, তা জানতে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, প্রক্রিয়াটির মধ্যে একাধিক স্তরে মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে এই অতিরিক্ত খরচ। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য শুরু হয় সৌদি আরব থেকে, শেষ হয় বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে।

জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিগুলো স্বীকার করেছে, সৌদি আরবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শ্রমিক নিয়োগের একেকটি চাহিদাপত্র বাংলাদেশে আনতেই মধ্যস্বত্বভোগীদের ১ থেকে ২ লাখ টাকা দিতে হয়। কারণ সেখানে একশ্রেণির বাংলাদেশি এই চাহিদা কেনাবেচায় জড়িত। বাংলাদেশে প্রতিটি চাহিদা আসার পর বিদেশে যেতে ইচ্ছুক শ্রমিক সংগ্রহে নামেন জেলা পর্যায়ের দালালেরা।

তাঁরা একেকজন ইচ্ছুক শ্রমিকের কাছ থেকে শুরুতেই ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা নেন। এরপর জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) কিংবা মন্ত্রণালয় থেকে শ্রমিক নিয়োগের অনুমতি নিতে মন্ত্রণালয়ে ধরনা দিতে হয়। বর্তমানে সৌদি আরবে প্রতিটি নিয়োগ অনুমতির জন্য মন্ত্রণালয়ের ঘনিষ্ঠ একজনকে ১৩ হাজার টাকা করে দিতে হয় বলে অভিযোগ করেছে শ্রমশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিগুলো।

এ ছাড়া বিএমইটির বহির্গমন ও মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখার একশ্রেণির কর্মকর্তা আর্থিক সুবিধা নেন। এই মধ্যস্বত্বভোগীদের পেছনে ব্যয় হওয়া অর্থ বিদেশগামী শ্রমিকের কাছ থেকে আদায় করা হয়। ফলে সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করতে হয়।

প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে নানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা বিষয়টি জানলেও তাঁরা এই অনিয়ম বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নেননি। তাই সরকারি কর্মকর্তাদের একটি অংশ এই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। বরং অনেকে এই দুর্নীতি করতে ঘুষ দিয়েও এখানে পদায়ন নিচ্ছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে শ্রমিক নিয়োগের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি রাজধানীর মালিবাগে একটি ব্যবসায়িক কার্যালয় থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ওই ব্যবসায়িক কার্যালয় পরিচালনাকারী মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা তুলে সেখানে পৌঁছে দেন। দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তাও সেখানে হাজিরা দেন। সাইদুরের একজন ভাগনে এবং এই সরকারি কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান শাখার বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ অনুমতির ফাইল নিয়ে যান।

জনশক্তি রপ্তানিকারক অন্তত ১০ জন প্রথম আলোর কাছে বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তাঁরা বলছেন, অর্থ না দিলে নিয়োগের অনুমতি পাওয়া যায় না। ফলে বাধ্য হয়ে সবাই এই চক্রের মাধ্যমে কাজ করেন।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন অনুযায়ী, বিদেশে শ্রমিক নিয়োগের জন্য এজেন্সিগুলোকে বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে নিয়োগের অনুমতি সংগ্রহ করতে হয়। মূলত এই নিয়োগের অনুমতি নিতেই ঘুষের বাণিজ্য চলে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত সাইদুর রহমান নাভিরা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বিষয়টি জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সাইদুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরে বার্তা পাঠিয়ে এ বিষয়ে জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর আরেকটি নম্বরে যোগাযোগ করা হলে অপর একজন ফোন ধরে বলেন, সাইদুর রহমান বৈঠকে আছেন।

ফোন দেওয়া যাবে না। রোববার বিকেলে সাইদুর রহমানের মগবাজারের কার্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, তিিন সেখানে নেই। নাভিরা লিমিটেডর আরেকজন পরিচালক ও সাইদুর রহমানের ছোট ভাই শামীম হাসানের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিদেশে যাঁরা যান, তিনি তাঁদের প্রক্রিয়াকরণের কাজগুলো করেন। অন্য বিষয়ে তাঁর কিছু জানা নেই।

এ বছরের জুন মাসে প্রধানমন্ত্রীর সৌদি আরব সফরের আগে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। তাতে মন্ত্রণালয়ের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অসাধু তৎপরতার কারণে সৌদি আরবে যাওয়ার অতিরিক্ত খরচের কথা বলা হয়। প্রতিবেদনে রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল, সরকার, মুনলাইট, গড গিফট, মুন্সী ওভারসিজ, এসভি ইন্টারন্যাশনালসহ ১৫টি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের নামও দেওয়া হয়েছে, যেগুলোর বিরুদ্ধে বেশি খরচে লোক পাঠানোর অভিযোগ আছে।

এই প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও তুর্কি অ্যাসোসিয়েটস, রাতুল ট্রেডিং, সানসাইন ওভারসীজ, মুসা ইন্টারন্যাশনাল, আল বারাকা, এম ইন্টারন্যাশনাল, আল রাবেতা, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট করপোরেশন, ধামাশি করপোরেশন, গ্রীনল্যান্ড ওভারসীজ, অ্যাসুরেন্স সার্ভিস কোম্পানি, জিএমজি ট্রেডিংসহ প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান সৌদি আরবের জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে।

সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহ আগস্টে ঢাকায় মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে শ্রমিকদের এই অতিরিক্ত খরচের বিষয়টি তুলে ধরেন। এ বিষয়ে টেলিফোনে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব ও বাংলাদেশের একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগীর কারণেই সৌদি আরবে কর্মী পাঠাতে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লেগে যায়। সৌদি আরব থেকে নিয়োগের চাহিদা উচ্চমূল্যে হাতবদল হয়ে বাংলাদেশে আসে।

এরপর আবার কয়েক হাত ঘুরে লোকজনকে বিদেশে পাঠানো হয়। সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে দুই দেশেরই মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা বন্ধ করতে হবে।

অভিবাসীদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি মাইগ্র্যান্টসের (ওয়ারবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৭ হাজার ৪০০ টাকায় লোক পাঠানোর বিষয়টি শুধু কাগজে-কলমে। বাস্তবে এখন ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা লাগছে বলে আমরা জানি। এ নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরে কথা বলছি, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। এ বিষয়ে নজরদারি দরকার।’

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক কমিটির সভাপতি এবং সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানিকারক আবদুল হাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৭ হাজার ৪০০ টাকায় লোক পাঠানো সম্ভব কি না, আপনারা ভালো বলতে পারবেন। তবে সৌদি আরবের বাজার এতদিন সীমিত ছিল, তাই বেশি খরচ হয়েছে। এখন পুরোদমে বাজার চালু হলে খরচ এমনিতে কমে যাবে। সরকার নির্ধারিত ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকাতেই তাহলে লোক পাঠানো সম্ভব হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বেশি টাকা যে নেওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমাদের কাছে কখনো কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। তবে এবার সৌদি আরবের জন্য যে খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, সেটি নজরদারি করা হবে।’ মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিক একটি চক্রের ঘুষ-বাণিজ্যের কারণেই বেশি খরচ হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘আমার এ বিষয়ে জানা নেই। তবে কথা দিচ্ছি, যে চক্রই থাকুক না কেন, তা অচিরেই বন্ধ হবে।’

জনশক্তি রপ্তানিকারকেরা বলছেন, সৌদি আরবের এই ভিসা কেনাবেচা অনেক দিন ধরেই চলছে। এর মধ্যে রাব্বী ইন্টারন্যাশনাল ও অ্যাসুরেন্স সার্ভিস কোম্পানির বিরুদ্ধে ভিসা কেনাবেচার অভিযোগ এনে ব্যবস্থা নিতে ২০১৪ সালের ১ জুলাই সে সময়ের মন্ত্রীকে একটি চিঠিও দেয় বায়রা। সৌদি আরবে কর্মী পাঠানোর সঙ্গে যুক্ত একটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালে যখন সৌদি আরবে চাহিদাপত্র কেনাবেচার অভিযোগ ওঠে, তখনই বায়রা আনুষ্ঠানিকভাবে সে সময়ের মন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিল। কিন্তু তখন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন সেই ধারাবাহিকতা চলছে।

জনশক্তি রপ্তানি খাতের অনিয়ম শনাক্ত করতে মন্ত্রণালয়ের একটি টাস্কফোর্স রয়েছে। ঢাকার হজরত শাহজালাল ও চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশগামী ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এই টাস্কফোর্স জানতে পেরেছে, শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের কারণে বাংলাদেশ থেকে একজন কর্মীর কাতার, বাহরাইন বা ওমানে যেতেও আড়াই থেকে ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হচ্ছে।

তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেপাল বা ভারতের একজন কর্মীর ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা লাগলেও একজন বাংলাদেশির বিদেশে যেতে ৫ থেকে ১০ গুণ বেশি টাকা লাগছে। সমস্যার সমাধানে দেশ অনুযায়ী খরচ নির্ধারণ করে দেওয়া এবং ব্যাংকের মাধ্যমে টাকাপয়সা লেনদেনের সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স।

মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীদের তৎপরতা বন্ধ করে বিদেশে যাওয়ার খরচ কমাতে ২০১৩ সালে সরকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন করে। ওই আইনের ১৯-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, এখন থেকে সরকারিভাবে নিবন্ধিত কর্মীর তালিকা ছাড়া কেউ বিদেশে যেতে পারবেন না। এটি মানলেই এই ঘুষপ্রথা বন্ধ হয়। কিন্তু চার বছর হয়ে গেলেও এই আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।

সূত্র: প্রথম আলো