যৌন শিক্ষা নিয়ে কথা বলতে এত লজ্জা কেন?

যৌন শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়৷ অথচ বাংলাদেশে এই নিয়ে কথা বলতে সংকোচ সবার মধ্যে, বিশেষ করে মেয়েরা তো মুখই খুলতে চায় না৷ আর জার্মানিতে ‘যৌন’ শব্দটি স্বাস্থ্যের সাথে কতটা জড়িত, তা শেখানো হয় প্রাথমিক স্কুলেই৷

188

এগারো-বারো বছর বয়সের পর থেকেই ছেলে-মেয়ে সবারই যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ে জানা দরকার৷ এই সময়টা বয়ঃসন্ধিকাল, অর্থাৎ কিশোর-কিশোরী থেকে নারী ও পুরুষ হয়ে ওঠার সময়৷ এই বয়স থেকে সাধারণত মেয়েদের ‘পিরিয়ড’ বা ‘মাসিক’ শুরু হয়৷ পাশাপাশি শরীর এবং মনে ঘটতে থাকে নানা পরিবর্তন৷

বাংলাদেশে মেয়েরা তাদের এই পরিবর্তনের খানিকটা ধারণা হয়ত পায় বড় বোন বা বান্ধবীদের কাছ থেকে৷ তাও অতি গোপনে, লুকিয়ে যেন বাড়ির বড়রা তা জানতে বা বুঝতে না পারে৷ ফলে মেয়েরা অধিকাংশক্ষেত্রে মাসিক সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পায় না৷ না বাড়িতে, না স্কুলে৷ আমার মনে পড়ে, ক্লাস সেভেনের বইয়ে ঋতুস্রাব সম্পর্কে ছোট করে অস্পষ্ট কিছু লেখা ছিল৷ কিন্তু শিক্ষক তা নিয়ে কোনো কথাই বলেননি৷ বরং বলেছেন, ‘বাড়িতে পড়ে নিও’৷ ভাবটা এমন যেন ব্যাপারগুলো বিয়ে হলেই জানবে, আগে জানবার প্রয়োজন নেই৷

বাংলাদেশে মেয়েলি ব্যাপারগুলো অত্যন্ত ‘গোপন বিষয়’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো তখন৷ আমি সেই সত্তরের দশকের কথা বলছি৷ এখন পরিস্থিতি কতটা বদলেছে জানি না৷ তবে এ সব বিষয় নিয়ে কথা না বলার পরিণতি টের পেয়েছিলাম জার্মানিতে আসার পর৷ প্রথমবার স্ত্রী বিশেষজ্ঞের কাছে চেকআপের জন্য গিয়ে বুঝতে পারি যে আমি অনেক স্বাভাবিক, সাধারণ বিষয়ই জানতাম না৷ আমি বড় হয়েছি একটি যৌথ পরিবারে৷ বাড়িতে অন্যান্য নানা বিষয় নিয়ে খোলাখুলিভাবে আড্ডা আলোচনা হলেও, এই বিষয়টি কিন্তু ‘ট্যাবু’-ই রয়ে গিয়েছিল৷

জার্মানিতে আসার পর এ দেশের খোলামেলা পরিবেশ, ছেলে-মেয়েদের রাস্তায় হাত ধরাধরি করে ঘুরে বেড়ানো, বাস ট্রামে চুমু খাওয়া দেখে মন্দ লাগেনি! তবে পরবর্তীতে নিজে যখন সন্তানের ‘মা’ হলাম, তখন অন্য চিন্তা মাথায় আসে৷ বাঙালি হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে প্রশ্ন করেছি, জার্মান সংস্কৃতির এই খোলামেলা পরিবেশ, ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা থেকে আমাদের আদরের কন্যাকে আগলে রেখে ভালোভাবে মানুষ করতে পারবো তো? অজান্তেই মনের ভেতর খানিকটা ভয় আর আতঙ্ক কাজ করতো তখন৷

মেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে ভাবনাও বাড়তে শুরু করে৷ কিন্তু এক পর্যায়ে বুঝলাম জার্মান শিক্ষা ব্যবস্থাই এমন যে, অনেক দায়িত্ব স্কুলই পালন করে৷ প্রাথমিক পর্যায়েই যৌন শিক্ষা, অর্থাৎ যৌনতা সম্পর্কে খোলাখুলিভাবে জানানো হয়৷ যৌন সম্পর্ক কী?, কম বয়সে যৌনতার ক্ষতিকর দিক, জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, গর্ভধারন, গর্ভপাত এবং অবশ্যই যৌনরোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে কিশোর-কিশোরীদের সচেতন করা হয় স্কুলেই৷

নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন করে দেয়া হয় তাদের৷ ফলে কোনটা ভালোবাসার স্পর্শ আর কোনটি অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে – সেটা তারা সহজেই বুঝতে পারে৷ যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের মতো কোন পরিস্থিতে করণীয় কী – সেটাও তাদের বোঝানো হয়৷

তবে শুধু স্কুল নয়, সন্তানকে ‘যৌনতা’ সম্পর্কে সচেতন করতে মা-বাবারও ভুমিকা রয়েছে৷ আর সেজন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সন্তানের সাথে সহজ সম্পর্ক তৈরি করা৷ যাতে সন্তান নিঃসংকোচে যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারে৷ আমি আমার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেক ঘনিষ্ঠ করে নিয়েছি একেবারে ছোটবেলা থেকেই৷ দু’জনে বন্ধুর মতো মিশেছি, নানা বিষয়ে কথা বলেছি৷ মেয়ে মনে করে, আমাদের বয়সের পার্থক্য খুব বেশি না থাকায় বন্ধুত্বের সম্পর্কটা সহজে হয়েছে! তবে আমার মনে হয়, বয়সের ব্যবধান যাই হোক, সন্তানের সঙ্গে যাতে মায়ের দূরত্ব কখনো তৈরি না হয় সেদিকে ভালোভাবে খেয়াল রাখতে হবে৷

বাংলাদেশ, এমনকি ভারতেও যৌনতা নিয়ে, যৌন শিক্ষা নিয়ে আরো খোলামেলা এবং শিক্ষিত আলোচনা হওয়া উচিত৷ এতে করে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়বে৷ আমার কাছে মনে হয় শিক্ষা, আধুনিকতা, ফ্যাশন আর পোশাকের দিক দিয়ে বাঙালিরা যতটা এগিয়ে গেছে, যৌন শিক্ষার দিক দিয়ে ততটাই পিছিয়ে রয়েছে৷