মেধার পরিচর্চা এবং পরীক্ষা পদ্ধতি

উচ্চশিক্ষার জন্য আমি কানাডায় এসেছি আট মাসের একটু বেশি হলো। আসার কিছুদিনের পর বাংলাদেশি এক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, কানাডা ও বাংলাদেশের পড়ালেখার মধ্যে পার্থক্য কি? যথেষ্ট পরিমাণ ক্লাস করার ও লেকচার শোনার আগেই বললাম, দেশে আমার পছন্দের কিছু শিক্ষকের ক্লাসে যে লেকচার শোনার সৌভাগ্য হয়েছে, এখানে এখনো সেরকম হয়নি।

ইতিমধ্যে আমার অনেকগুলো কোর্স শেষ হয়েছে এবং উত্তরটা এখনো একই। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানকার শিক্ষকেরা কি তাহলে যথেষ্ট দক্ষ নন! কথাটা অন্যভাবেও তো ভাবতে পারি। আমাদের দেশের শিক্ষকেরা এখানকার চেয়েও বেশি দক্ষ। অবশ্য এ রকম তুলনা করাটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। কারণ প্রত্যেক জায়গার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তুলনা করতে গেলে অনেক কিছুই আমলে নিতে হয়, তা না হলে ভুল ধারণার অবকাশ থাকে।

তবে এ কথা সত্যি। শুধু আমার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়েই না, অনেক অনলাইন ক্লাস দেখেছি, এমআইটি কেমব্রিজের ভিডিও লেকচারও শুনেছি। বাংলাদেশের অনেক ক্লাস লেকচারের মান ওই সব লেকচারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। তাহলে পার্থক্যটা কোথায়? আমার দৃষ্টিতে পার্থক্য মনে হয়েছে যাচাই পদ্ধতিতে (ইভালুয়েশন সিস্টেম)। আমার বিষয় পদার্থবিজ্ঞানের কথা যদি বলি, গবেষণার সূক্ষ্ম ক্ষমতা লব্ধ করার জন্য অনেক গাণিতিক সমস্যা সমাধান (প্রবলেম সলভিং) করাটা আবশ্যক। পদার্থবিজ্ঞানের কিছু বইকে নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের জন্য এনসাইক্লোপিডিয়া বলা চলে। এই সব বইয়ের অধ্যায় শেষে যে সমস্যাগুলো থাকে সেগুলোর কয়েকটা অন্তত সমাধান করতে পারলে বাংলাদেশি কোনো ছেলের গবেষণা হাতেখড়ির জন্য আর খুব বেশি দীক্ষা নিতে হবে না।

এ রকম কয়েকটা বই যদি বলতে হয় আমি বলব, রেজনিক ও হেলিডের ফান্ডামেন্টালস অব ফিজিক্‌স, গোল্ডস্টাইনের ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স, গ্রিফিথসের ইন্ট্রোডাকশন টু ইলেকট্রোডায়নামিক্স, জ্যাকসনের ক্লাসিক্যাল ইলেকট্রোডায়নামিক্স। এই বইগুলোর অন্তত দশটা করে সমস্যার সমাধান স্নাতক ডিগ্রি নেওয়াকালে যদি কেউ করতে পারে তাতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রেমে পড়তে বেশিদিন লাগবে না। আর গবেষণায় কত দূর যেতে পারবে তা কাউকে বলে দিতে হবে না, সে নিজেই অনুমান করতে পারবে।

এখন আসি আসল প্রসঙ্গে। এসব দেশে, বিশেষ করে আমেরিকান বা দক্ষিণ আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোর্সের যাচাই পদ্ধতি সম্পূর্ণ নির্ভর করে এ রকম সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে। প্রতি কোর্সে অনেকগুলো অ্যাসাইনমেন্ট থাকবে এসব সমস্যার ওপর। ফাইনাল বা মিড টার্মে কোনো প্রশ্নই সরাসরি লেকচার থেকে আসবে না। ধারণা পরিষ্কার থাকলে পরীক্ষা তখন খেলা! কিন্তু ধারণা পরিষ্কার হবে যদি অ্যাসাইনমেন্টের সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারেন। নতুন সমস্যার সমাধান করার যোগ্যতা আপনার হয়ে যাবে। আর সমস্যা সমাধান করাই কিন্তু গবেষকদের কাজ। তার মানে আপনি ইতিমধ্যে গবেষণার দুয়ারে কড়া নাড়ছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের দেশে তা হচ্ছে না কেন? না হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ফান্ডের অভাব। এসব দেশে অ্যাসাইনমেন্ট চেক করার কাজ করানো হয় গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে। তাদের শিক্ষকের সহকারী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ভালো অঙ্কের টাকা এর জন্য বরাদ্দ থাকে। অন্যদিকে আমাদের দেশে এই কাজটি করতে হয় শিক্ষককে নিজে। কিন্তু একজন শিক্ষকের মৌলিক কাজ হচ্ছে গবেষণা করা। সেই শিক্ষক এখন খাতার পর খাতা দেখতে থাকবেন, নাকি লেকচারের প্রস্তুতি নেবেন, নাকি সংসার চলবে কীভাবে সে চিন্তা করবেন? আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলে তো হিসাব আরও জটিল। কিন্তু আমি জানি, এর একটা সহজ সমাধান আছে।

এসব দেশে অ্যাসাইনমেন্টের খাতা দেখার জন্য টাকা দিতে হলেও, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমার দেশের স্নাতকোত্তর পর্যায়ের ছাত্ররা সেই কাজ পারিশ্রমিক ছাড়াই করে দেওয়ার মতো যথেষ্ট উদার। স্বেচ্ছাসেবী কাজ করতে বাংলাদেশের কোনো ছাত্রকেই দ্বিধাবোধ করতে দেখিনি কখনো। দিনের পর দিন রোদে পুড়ে ক্যানসার আক্রান্ত বন্ধুর জন্য ফান্ড তৈরি যারা করতে পারে তারা নিশ্চয় এই কাজে পিছপা হবে না। তার চেয়েও বড় বিষয়, আমাদের ডিপার্টমেন্টে যে প্রথা দেখে এসেছি এর চেয়ে বড় আশার বিষয় কিছুই নেই। একেকজন সিনিয়র ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করে জুনিয়রদের পড়া বোঝাতে সাহায্য করেন। এই সময় কানাডাতে কোনো সিনিয়রের কাছ থেকে পেতে হলে ঘণ্টায় বেশি না, কমপক্ষে পঁচিশ ডলার করে খরচ করতে হবে। আমি ভাবছি, সময় হলে কিছুদিন এখানে বিনা মূল্যে কিছু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীকে পড়াব, বাংলাদেশকে চিনাব, এটাই বাংলাদেশ!

এখানে অনেককেই দেখেছি স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে সিভি রিচ করার জন্য। কিন্তু আমার দেশের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাংলাদেশের ছাত্ররা এত স্বেচ্ছাসেবী কাজ করে, কিন্তু কখনো সিভি রিচ হবে সেটা ভাবনাতেই আনে না। কেউ দেশ নিয়ে হতাশ হলে আমি অবাক হই! থাকতে পারে হাজারো সমস্যা, কিন্তু আমি সম্ভাবনার অনেক কিছুই দেখতে পাই।

যা হোক প্রসঙ্গে আসি, এত ভালো দিকের মাঝেও কিছু ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের সেই উদারতাটা অনেক ক্ষেত্রে আবার মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যাবে। ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাইয়েরা তখন বাসায় লাইন ধরবে। আমরা জাতি হিসেবে অনেক আবেগপ্রবণ। আবেগের বসে অনেক ভুলকেও প্রশ্রয় দিই। তাই খাতা দেখতে দিলে অবস্থা কি দাঁড়াবে আঁচ করাই যায়। কিন্তু সেটাও কড়া নজরদারি দিয়ে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের একটা ব্যবস্থা করা যাবে। তার পরেও বড় সমস্যা থেকেই যায়। কোনো শিক্ষার্থী বিনা পারিশ্রমিকে খাতা দেখতে গিয়ে হলের সিট হারানোর ভয়কে উপেক্ষা করলেও মূল্যবান জীবননাশের হুমকি নিশ্চয় উপেক্ষা করতে পারবে না! এই একটা জায়গায় আমি শুধু সমস্যার কথাই বলতে পারছি, সমাধান দেখানোর যোগ্যতা আমার নেই, স্বীকার করি।

আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলের শাখা সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে কি-ই বা দরকার এখন, আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে বোধোদয় হয় না। বাংলাদেশের মতো ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অন্য কোথাও আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু নিকট অতীতের সেই ইতিহাস আমাদের খুব একটা সুখের নয়। প্রায়শই মনে হয়, এই সময়ে দলীয় ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে ছাত্রদের সৃজনশীল কাজ থেকে দূরে রাখার কতটুকু প্রয়োজনই বা আছে।

অনেকে বলতে পারেন নেতৃত্ব গুণ সৃষ্টির জন্য এর প্রয়োজন আছে। তাহলে কি এই সব দেশের ছাত্ররা নেতৃত্বগুণ সম্পন্ন নয়? এখানেও ছাত্রসংগঠন আছে, নির্বাচন হয়, ছাত্রদের দাবি নিয়ে প্রতিবাদও হয়। যেটা নেই সেটা হচ্ছে কোনো দলীয় শাখা নেই। রাজনীতি বিষয়টা আমি একেবারেই বুঝি না। বুঝতে পারব বলেও মনে হয় না, তাই আমার ধারণায় ভুল থাকতে পারে, মানি। তবে আমার খালি চোখে দেখে মনে হয়, রাজনীতি বিষয়টা অনেক জটিল, অনেক কঠিন সমীকরণ সম্ভবত থাকে এখানে। আর সেখানেই আমি আশার আলো পাই। যে ছাত্ররা এত অল্প বয়সেই সেই কঠিন সমীকরণগুলো ধাতস্থ করে ফেলে তাদের নিশ্চয় একটু সময় দিলে গণিতের বা বিজ্ঞানের তুলনামূলক সহজ সমীকরণ আয়ত্ত করা আরও সহজ হবে। আগেই বলেছি এখানে কোনো সমাধান খোঁজা বা মন্তব্য করার যোগ্যতা আমার নেই। তবে এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানীজনের কাছে এই বিষয়টা নিয়ে নতুন করে ভাবার অনুরোধ জানাতেই পারি।

যেটা লিখতে বসেছিলাম সেটা লিখেই শেষ করি। ঠিক পরামর্শ বলব না, চিন্তার শেয়ার করছি, ভালো লাগলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সব সময় সমস্যা সমাধান চর্চার সুযোগ হয়ে না উঠলেও যারা গবেষণায় আগ্রহী বা উচ্চ শিক্ষার জন্য বাইরে আসতে চান তারা নিজ নিজ বিষয়ের ভালো বইগুলোতে দেওয়া গাণিতিক সমস্যার অন্তত কয়েকটি করে সমাধান করার চেষ্টা করবেন। সমাধানে না আসতে পারলেও কোনো সমস্যা নেই, শুধু চেষ্টা করলেই দেখবেন নিজের অজান্তেই ক্রিটিক্যাল থিংকিং ক্ষমতা

কল্পনাতীতভাবে বেড়ে যাবে। পরেরবার অন্য কোনো গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে গেলেই নিজের মধ্যে পরিবর্তনটা দেখতে পাবেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা পদ্ধতিতে এ রকম ব্যবস্থার সংযোজন করতে পারলে, আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, গবেষণায় আমাদের দেশের ছাত্ররা গোটা বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে। নিশ্চয়ই একদিন তাই হবে, আমি বিশ্বাস করি।

(লেখক পিএইচডি শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রনমি, ইউনিভার্সিটি অব ম্যানিটবা, উইনিপেগ, ম্যানিটবা, কানাডা। ইমেইল: [email protected])