বিশ্বখ্যাত ‘নেচার’ জার্নালে চবি’র নৃবিজ্ঞানী ড. ফরিদের সাফল্য

এই যুগান্তকারী উদ্ভাবনটি তুলে এনেছেন চারজনের একদল গবেষক। বিশ্বের নামকরা জার্নাল ‘নেচার’-এ সম্প্রতি (২০১৮ সালের জুনে) ওই গবেষণা প্রবন্ধটি ছাপা হয়। ছাপা হওয়ার পর থেকেই প্রবন্ধের ফলাফল দ্রুত সারাবিশ্বের চিকিৎসা-দুনিয়ায় সাড়া ফেলে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ছাড়াও দ্য টেলিগ্রাফ, দ্যা ডেইলি মেইলসহ ৬৫ টি আন্তর্জাতিক মিডিয়া আউটলেটে গুরুত্বের সাথে প্রবন্ধের ফলাফল প্রকাশিত হয়। (সূত্র: https://www.nature.com/articles/s41559-018-0567-6/metrics)। এখনও পর্যন্ত ৮০ হাজারেরও বেশি সাইটেশন পায় প্রবন্ধটি।

আর এই গবেষণাকর্মের অন্যতম ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ। অপর তিনজন হলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্যাসন মাগিড, যুক্তরাজ্যের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জিনিয়ান বেনট্লি এবং যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রবার্ট চেটারটন।

গবেষণাকর্মটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইকোনমিক এ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ কাউন্সিল (ইএসআরসি)’, ‘দ্যা রয়্যাল সোসাইট এ্যান্ড প্রোস্টেট ক্যান্সার ইউকে’ এবং গবেষকদের নিজস্ব অর্থায়নে সম্পাদিত হয়।

গবেষণা প্রবন্ধে ওঠে আসে যেসব পুরুষ বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত স্বচ্ছল পরিবার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগমুক্ত শৈশব কাটিয়ে বেড়ে উঠে তাদের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি হয়। এরা দ্রুত বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছায় এবং দ্রুত দীর্ঘ দৈহিক গড়নের অধিকারী হয়। তবে পরিণত বয়সে তারা প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে।

অন্যদিকে যেসব পুরুষ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে নানা ধরনের সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে-হতে শৈশব পার করে পরিণত বয়সে তাদের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণ কম হয়। এই কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদন মানবশরীরের দীর্ঘস্থায়ী (ক্রোনিক) অসুস্থতার জন্য দায়ী।…এভাবেই শৈশবের পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুরুষের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করে।

এ ব্যাপারে ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বলেন, ‘ছাপা হওয়ার পর থেকেই তা দ্রুত বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। একজন পুরুষ মানুষের হরমোন নিঃসরণের পরিপূর্ণ মাত্রা তার বংশ-পরম্পরা কিংবা পরিণত বয়সে সে যেখানে বসবাস করে এর উপর নির্ভর করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা নির্ভর করে তার শৈশবকালীন পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর। এটাই এ গবেষণার অন্যতম বড় একটি প্রাপ্তি।’

তিনি জানান, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ৩৫৯ জন ছেলেশিশু ও পরিণত বয়সী পুরুষের উচ্চতা, ওজন, বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছার বয়স, টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত তথ্য নিয়ে ওই গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়।

মোট চারটি ভাগে গবেষণা-নমুনাকে ভাগ করা হয়। এক. সেইসব পুরুষ যারা বাংলাদেশের সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা। দুই. যারা বয়স ৮ হওয়ার আগেই লন্ডনে গেছেন এবং সেখানেই বেড়ে উঠেছেন। তিন. যারা পরিণত বয়সে সিলেট ছেড়ে লন্ডনে গেছেন এবং চার. বাংলাদেশে থেকে লন্ডনে অভিগমনকারী মা-বাবার সন্তান।

গবেষণায় দেখা গেছে, যারা বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত পরিবার ও পরিবেশে বেড়ে উঠেছে তাদের তুলনায় যারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে যুক্তরাজ্যের পরিবেশ ও প্রতিবেশে বেড়ে ওঠেছে তাদের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি।

ড. ফরিদ বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে পুরুষদেহের শক্তি খরচের মাত্রা নির্ভর করে এর পরিবেশের ওপরও। যে পরিবেশে অসুস্থতা ও রোগসংক্রমণ বেশি এবং যারা খাবার থেকে কম পুষ্টি পায়। সেই পরিবেশে দেহকে টিকে থাকার জন্য বেশি শক্তি খরচ করতে হয়। এ কারণে তখন শরীর কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদন করে। শরীরে কম টেস্টোস্টেরন উৎপাদনের হার আবার মানবশরীরের দীর্ঘস্থায়ী (ক্রোনিক) অসুস্থতার জন্য দায়ী।

অন্যদিকে, যারা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত পরিবার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রোগমুক্ত শৈশব কাটিয়ে বেড়ে উঠেছে তাদের টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি থাকে। একইসঙ্গে সুস্থ থাকার জন্য তাদের কঠোর পরিশ্রম করতে হয় না বলে তাদের শরীরে বেশি টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসৃত হয় যা তাদের দ্রুত দীর্ঘ দৈহিক গড়নের অধিকারী করে তোলে।

তবে ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, যাদের এই টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরণের মাত্রা বেশি থাকে পরিণত বয়সে তাদের প্রোস্টেট ক্যান্সার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সমস্যা হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানে ও নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় এই ফলাফল ‘এক নতুন সংযোজন’।