বাংলা বানানে কিছু দ্বিধা

বাংলা বানান লিখতে গেলে আমরা প্রায়ই দ্বিধায় ভুগি। তবে বিষয়টা ভেঙে ভাবতে পারলে এই দ্বিধা সহজেই কেটে যায়।
লেখালেখি করতে গেলে সবচেয়ে যে জিনিসটা মাথায় ঘোরে, তা হলো— আচ্ছা ঐ বানানটা যেন কী? এখানে কি ও-কার হবে, নাকি এমনিই থাকবে? বিষয়টা কঠিন, আবার সহজও। বিষয়টা ভেঙে-ভেঙে ভেবে নিজে প্রশ্ন করে-করে আগালে এই সমস্যা নিজে-নিজেই সমাধান করে ফেলা যায়। কীভাবে? সেটাই তো দক্ষতা।
আজ আমরা শিখব কীভাবে ক্রিয়াপদের বানানগুলো ঠিকঠাক করতে হয়—
১) প্রথম দ্বিধাটা ক্রিয়াপদের শেষে ও-কার ব্যবহার নিয়ে।
বল তো দেখি কোনটা হবে?
হল নাকি হলো?
গেল নাকি গেলো?
করব নাকি করবো?
করছ নাকি করছো?
করত নাকি করতো?
হব নাকি হবো?
হুম, চিন্তার বিষয় বটে, এই দ্বন্দ্বে আমরা অনেকেই পড়ি। সাধারণ সমাধানটা হচ্ছে ক্রিয়াপদের শেষে অযথা ও-কারের দরকার নেই। করব, করত, করছ, করছিল, করেছিল, হব ইত্যাদি ক্রিয়াপদ এসেছে যথাক্রমে করিব, করিত, করিতেছ, করিতেছিল, করিয়াছিল ও হইব থেকে। সাধু ভাষার ঐ ক্রিয়াপদগুলোতে ও-কার নেই বলে চলিত ভাষায়ও ও-কার হবে না। তবে ও-কার না দিলে যেসব ক্রিয়াপদ বুঝতে অসুবিধে হবে, সেগুলোতে ও-কার দিতে হবে। যেমন—
‘হল’ বলতে hall-ও বোঝায়, তাই ‘হইল’-এর চলিত রূপ ‘হলো’ লেখাই উত্তম;
‘হত’ বলতে নিহতও বোঝায়, তাই ‘হইত’-এর চলিত রূপ ‘হতো’ লেখাই উত্তম;
‘করাত’ বলতে গাছ কাটার অস্ত্রবিশেষও বোঝায়, তাই ‘করাইত’-এর চলিত রূপ ‘করাতো’ লেখাই উত্তম।
২) দ্বিতীয় দ্বিধাটা অনুজ্ঞাবাচক ক্রিয়াপদে ও-কার ব্যবহার নিয়ে। যেমন :
‘কর’ বলতে কর্, করো, কোরো— তিনটাই বোঝায়।
এর সমাধান কী?
ক) তুচ্ছার্থক ক্রিয়াপদের শেষে হসন্ত দেয়া যেতে পারে, না দিলেও চলে। যেমন : তুই কাজটি কর। ঘটনাটা তুই খুলে বল। তুই ওকে ধর।
খ) তুমি-এর বেলায় তৎক্ষণাৎ নির্দেশের ক্ষেত্রে ও-কার ব্যবহার করতে হবে। যেমন : কাজটি এখনই করো। ঘটনাটা খুলে বলো তো। ধরো ওকে।
গ) তুমি-এর বেলায় ভবিষ্যৎ নির্দেশের ক্ষেত্রে দুটো ও-কার ব্যবহার করতে হবে। যেমন : তুমি তোমার সুবিধামতো সময়ে কাজটি কোরো। আমি বাড়ি ফেরার পর ধীরেসুস্থে ঘটনাটা বোলো। ওকে পরে ধোরো।
৩) তৃতীয় দ্বিধাটা একটু জটিল। অনেকেই ওঠে-উঠে, তোলে-তুলে, বোঝে-বুঝে, কেনে-কিনে, মেশে-মিশে, শেখে-শিখে ইত্যাদি ক্রিয়াপদকে গুলিয়ে ফেলেন। এক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে সমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের বিবৃত রূপ (যেমন : ওঠে, তোলে, বোঝে, কেনে, মেশে, শেখে) এবং অসমাপিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের সংবৃত রূপ (যেমন : উঠে, তুলে, বুঝে, কিনে, মিশে, শিখে) ব্যবহৃত হবে।
বিবৃত রূপ কী?
যেটা উচ্চারণ করতে ঠোঁট বেশি মেলতে হয়, সেটা।
সংবৃত রূপ কী?
যেটা উচ্চারণ করতে ঠোঁট কম মেলতে হয়, সেটা। যেমন : উচ্চারণের ক্ষেত্রে ঠোঁট বেশি মেলতে হয় ওঠে ও মেশে-তে, কম মেলতে হয় উঠে ও মিশে-তে। তাই ওঠে ও মেশে হচ্ছে বিবৃত রূপ এবং উঠে ও মিশে হচ্ছে সংবৃত রূপ।
সমাপিকা ক্রিয়া কী?
যে ক্রিয়াপদ দ্বারা একটি বাক্য শেষ হয়। যেমন : সে ঘুম থেকে ওঠে। সে ফুল তোলে। সে ভালো মানুষদের সাথে মেশে। সে বই কেনে। সে গান শেখে। এখানে ওঠে-তোলে-মেশে-কেনে-শেখে দ্বারা বাক্য শেষ হয়ে যাচ্ছে, তাই এখানে ক্রিয়াপদের বিবৃত রূপটা ব্যবহৃত হলো।
অসমাপিকা ক্রিয়া কী?
যে ক্রিয়াপদ দ্বারা একটি বাক্য শেষ হয় না, কিছু বাকি থেকে যায়। যেমন: সে ঘুম থেকে ‘উঠে’ স্কুলে যায়। সে ফুল ‘তুলে’ মালা গাঁথে। সে ভালো মানুষদের সাথে ‘মিশে’ অনেক কিছু জেনেছে। সে গান ‘শিখে’ বড় শিল্পী হবে। এখানে উঠে-তুলে-মিশে-শিখে দ্বারা একটি বাক্যও শেষ হয়নি। তাই এরা অসমাপিকা ক্রিয়া এবং এসব ক্ষেত্রে ক্রিয়াপদের সংবৃত রূপ ব্যবহৃত হয়েছে।
এখন তো তা হলে আর ভুল হবে না, তা-ই না? নতুন কিছু শিখলে সেটা বারবার চর্চা করতে হয়। এভাবে মনে থাকে বেশি আর ভুলও হয় কম।