জেনে নিন ক্রিকেট খেলার ইতিহাস এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য!

বিশ্বজুড়ে ফুটবলের জনপ্রিয়তার পরই রয়েছে ক্রিকেটের স্থান। তবে ফুটবলের মতো সব দেশে ক্রিকেটের প্রচলন না থাকলেও বর্তমান সময়ে অনেক ফুটবল খেলুড়ে দেশ ক্রিকেটের দিকে ঝুঁকছে। টেস্ট, ওয়ানডে কিংবা টি-টুয়েন্টি সব ধরনের ক্রিকেটের নাড়ি নক্ষত্র আমাদের জানা। কিন্তু আমাদের অনেকেরই জানা নেই ব্যাট-বলের এই খেলাটি কিভাবে এলো। আসুন আমরা সে বিষয়ে কিছু তথ্য জেনে নিই।

শুরুর দিকের কথা:
ফুটবলের মতো ক্রিকেটের জনক কে তা নিয়েও রয়েছে বিভিন্ন মত। তবে বেশিরভাগ মতই বলছে ক্রিকেটের জন্ম হয় ইংল্যান্ডে।  কিন্তু বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত থেকে জানা যায় ক্রিকেটের প্রচলনটা শুরু হয় ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাব অঞ্চলের ‘দোয়াব’ এলাকায়। ৭ম শতাব্দীতে এই এলাকায় ব্যাট এবং বল নামে এক ধরনের খেলা হতো। তাদের মাধ্যমে ৮ম শতাব্দীর আরও কিছু পরের সময়ে খেলাটি পারস্যের দিকে প্রচলিত হতে থাকে। ইউরোপে খেলাটির প্রচলন সম্পর্কে জানা যায়, ১০ম শতাব্দীর আগে প্রাচীন ভারতীয় মরুভূমিতে বসবাসকারী ‘নরম্যাডিক জিপসি’রা তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যায় এবং সেখানে দিয়ে তারা তাদের মধ্যে প্রচলিত এই খেলাটি খেলে থাকে। তাদের দেখাদেখিই ইউরোপীয়দের মধ্যে খেলাটির প্রচলন হয়। বল নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের খেলা প্রচলিত ছিল। তবে বলের সাথে ব্যাটের উদ্ভব হয়েছে দক্ষিণ ভারতে। সেখানে ব্যাটকে ‘ডান্ডা’ বলা হতো।

amazing-history-of-cricket-pic1ক্রিকেটের আদি সংস্করণ:
১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ইংল্যান্ড বিজয়ের পর নরম্যানরা চিত্ত-বিনোদনের জন্য ব্যাট-বলের খেলার ধারণাটি গ্রহণ করে। তাদের হাত ধরেই গোড়াপত্তন হয় ক্রিঘ (creagh)/ ক্রিকে (cricke) নামক খেলার। সে সময় শুধুমাত্র সপ্তাহের রবিবার এই খেলাটি খেলা হতো। খেলাটির ধরন ছিল এরকম – একটি বল একজন ব্যাটসম্যানের দিকে ছুড়ে মারা হতো। ব্যাটসম্যানের ঠিক পেছনেই আজকের স্ট্যাম্পের মতো এক ধরনের কাঠামো থাকতো। ব্যাটসম্যান সেই কাঠামোকে বলের আঘাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার হাতে থাকা কাঠের তক্তা দিয়ে বলটিকে বাড়ি মারতো। ব্যাটসম্যানের বাড়ি মারা বলটিকে ধরার জন্য তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কয়েকজন ফিল্ডারও থাকতো। ১১৮৩ খ্রীস্টাব্দে জোসেফ অব এক্সেটার নামক লেখকের লেখা থেকে এরকমটিই জানা যায়।

amazing-history-of-cricket-pic3ক্রিকেটের অন্ধকার যুগ:
১৪০০ খ্রিস্টাব্দে এসে শুরু হয়ে যায় রাজ্য জয়ের প্রতিযোগিতা। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত চলে এ প্রতিযোগিতা। এ সময় ক্রিকেটের উপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞা। কেননা ক্রিকেট খেলার কারণে যুদ্ধ করার মতো প্রয়োজনীয় সৈনিক পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই রাজা দ্বিতীয় রিচার্ড ইংল্যান্ডে ক্রিকেট খেলা নিষিদ্ধ করেন সে সময়টাতে। যদি কেউ এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ক্রিকেট খেলতো, তাহলে তাকে শাস্তি দেওয়া হতো।

আবার ক্রিকেটের এগিয়ে যাওয়া:
১৫০০ খ্রিস্টাব্দের পর ইউরোপে রাজ্য জয়ের প্রতিযোগিতা প্রায় বন্ধ হয়। সেই শতকের শেষের দিকে ইতালিয় রেনেসার প্রভাবে ইউরোপের শিল্প-সংস্কৃতির খোলস পাল্টে যেতে শুরু করে। যার ছিটেফোটা খেলাধুলার গায়েও লাগে। ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে যেই খেলাটির নাম ছিল ক্রিঘ (creagh) বা ক্রিকে (cricke), সেটিই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে এসে পরিচিতি লাভ করে ক্রিকেট (crickett or crickette)  নামে। আস্তে আস্তে ক্রিকেট খেলার কারণে যে শাস্তির বিধান করা হয়েছিল সেটি উঠে গেছে ধারণা করলেও এক ধরনের অলিখিত নিষেধাজ্ঞাকে সাথে নিয়েই আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে ক্রিকেট। বিশেষত ধর্মযাজকরা এই খেলাটির ঘোর আপত্তি করতে থাকে। তাদের মতে, ক্রিকেট হলো অলস, অকর্মন্য আর জুয়াড়িদের খেলা। ধর্মযাজকরা এর বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থাও করেছিল। কিন্তু কোনো বাঁধাই বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি ক্রিকেটের চলার পথে।

আধুনিক ক্রিকেটের পথচলা:
কাউন্টি ম্যাচের মাধ্যমে আধুনিক ক্রিকেটের পথচলা শুরু হয়। ১৭১৯ সালে ইংল্যান্ড জাতীয় দল ও কেন্ট দলের মধ্যকার ম্যাচটির মাধ্যমে। ১৭২১ সালে ভারতবর্ষে আধুনিক ক্রিকেটের প্রচলন হয় ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। তবে ১৭৪৪ সালের আগে ক্রিকেট পুরোপুরি আধুনিক হয়ে উঠেনি। কেননা সে সময়ও নিয়ম-কানুন মেনে ক্রিকেট খেলা হতো না। ১৭৪৪ সালে আধুনিক ক্রিকেটের বিভিন্ন নিয়ম-কানুন করা হয় এবং সেই নিয়ম মোতাবেক ক্রিকেট খেলা শুরু হয়।

amazing-history-of-cricket-pic4

টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম:
১৮৭৭ সালে এসে টেস্ট ক্রিকেটের জন্ম হয়। ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচে অংশগ্রহণ করে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। ১৮৭৭ সালের ১৫ ই মার্চ ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম ওয়ানডে ম্যাচেও অংশ গ্রহণ করে এই দুটি দল। দুই ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়া জয় লাভ করে। বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা হিসেবে ‘ইম্পেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্স’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৯ সালে। পরে ১৯৫৬ সালে ‘ইম্পেরিয়াল’ কথাটি পরিবর্তন করে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ শব্দটি যোগ করে ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল’ রাখা হয়। সংক্ষেপে আইসিসি। ১৮৮২-৮৩ সাল থেকে শুরু হয় মর্যাদাপূর্ণ অ্যাশেজ লড়াই। এরপর থেকে অন্যান্য দেশ টেস্ট ক্রিকেটে একে একে পদার্পণ করে। দক্ষিণ আফ্রিকা ১৮৮৮-৮৯, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১৯২৮, নিউজিল্যান্ড ১৯২৯-৩০, ভারত ১৯৩২, পাকিস্তান ১৯৫২-৫৩, শ্রীলঙ্কা ১৯৮১-৮২, জিম্বাবুয়ে ১৯৯২ এবং বাংলাদেশ ১৩ নভেম্বর, ২০০০।

ওয়ানডে ক্রিকেটের জন্ম:
শুরুর দিকে টেস্ট ম্যাচগুলো অনেক দিন ধরে চলত। কেননা এখনকার মতো নির্দিষ্ট কোনো দিনের হিসাব ছিল না। তখন ম্যাচ দেখার জন্য প্রচুর দর্শক হতো। এই সময়েই টিকিট কেটে খেলা দেখার প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর কারণে অনির্দিষ্ট দিন ধরে চলতে থাকা এই খেলা প্রায়ই বন্ধ থাকতো। এই নিয়ে আয়োজক ও দর্শকদের মধ্যে লাগতে থাকে গন্ডগোল। একই সাথে কমতে থাকে ক্রিকেটের দর্শক। ক্রিকেট মাঠে দর্শক ফিরিয়ে আনা ও আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে রাগনেল হার্ভের উদ্যোগে রথম্যানস কো. ৪০ ওভারের একটি টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। খেলা হতো রোববারে। তাতে খেলতেন কাউন্টি দলগুলোর বিপক্ষে চলতি ও প্রাক্তন তারকা খেলোয়াড়দের সম্মিলনে গড়া ইন্টারন্যাশনাল কার্ভেলিয়ার্স। এই ম্যাচগুলো লাইভ প্রোগ্রাম দেখাত বিবিসির ২ নম্বর চ্যানেল। ফলাফল অভূতপূর্ব সাফল্য। যেসব দর্শক তিন দিনের ফলাফলবিহীন অসমাপ্ত ম্যাচ না দেখার জন্য মাঠ ত্যাগ করেছিলেন, তারাই সকাল-বিকালের ম্যাচে জয়-পরাজয় প্রত্যক্ষ করার জন্য নাড়ির টানে মাঠে আসতে শুরু করল।

পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে জিলেট কাপ নামে ৬০ ওভারের এক টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ইংল্যান্ডে। এই টুর্নামেন্টই ১৯৮১ সালে ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি নামে পরিচিতি লাভ করেন। এর আগে ১৯৬৯ সাল থেকে ৪০ ওভারের একটি টুর্নামেন্ট এর প্রচলন ছিল। খেলা হতো প্রতি রবিবার। টুর্নামেন্টটির নাম ছিল ‘জনপ্লেয়ার স্পেশাল লিগ’। ইংল্যান্ডের দেখাদেখিই টেস্ট খেলুড়ে অন্যান্য দেশগুলোতেও সীমিত ওভারের খেলার প্রচলন শুরু হয়। ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে ইংল্যান্ড বনাম অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচ দিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের শুরু হয়। প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে অস্ট্রেলিয়া জয়ী হয়।

বিশ্বকাপ ক্রিকেট:
বিশ্ব ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা ‘আইসিসি’ ক্রিকেট খেলুড়ে সবগুলো দেশ একসাথে নিয়ে নতুন এক টুর্নামেন্টের চিন্তা করে। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই ১৯৭৫ সালের ৭ জুন প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের পর্দা ওঠে। প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজক ছিল ইংল্যান্ড এবং সেই টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করে স্বাগতিক ইংল্যান্ড, পূর্ব আফ্রিকা, শ্রীলংকা, অস্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত, পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ড। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ওই ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে ১৭ রানের ব্যবধানে পরাজিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব অর্জন করে। এতে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন ক্লাইভ লয়েড।

বাংলাদেশের ক্রিকেট:
১৯৭৫ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে এশিয়ার ৩টি দেশ অংশ নেয়। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ অনেক দেরিতে ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ওয়ানডে স্ট্যাটাস পায়। পরবর্তীতে ২০০০ সালে এসে বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পায়। ২০০৫ সালে এসে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট ম্যাচ জয়ের স্বাদ পায়। তবে ওয়ানডে ম্যাচ জয়ের স্বাদ পেতে বাংলাদেশকে এতোটা অপেক্ষা করতে হয় নি। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ প্রথম ওয়ানডে ম্যাচে জয় লাভ করে। ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে চমক সৃষ্টি করেছিল বাংলাদেশ।