কেমন হবে শিক্ষার্থী শিক্ষক সম্পর্ক!

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হওয়া প্রয়োজন? আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক যে খুব একটা পারস্পরিক সম্মানজনক অবস্থায় নেই সেটা সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনাতেই বোঝা যায়। নুসরাত হত্যার সঙ্গে জড়িত সোনাগাজীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কল্পনা করা যায়, একজন অধ্যক্ষ তার দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে বসে অপহরণের পরিকল্পনা করছে, তাকে হত্যা করছে। কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে শিক্ষকসমাজ! এই এপ্রিলেই রাজধানীর ডেমরার ডগাইর এলাকার নূরে মদিনা মাদ্রাসার ছাত্র আট বছরের মনির হোসেনকে হত্যার সঙ্গে ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ দুই শিক্ষার্থী জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

গতকাল শুক্রবার ইত্তেফাকের শেষ পাতায় ছাপা হয়েছে সংবাদটি। ‘পরীক্ষার হলে চুল কেটে দিলেন প্রধান শিক্ষক’। অবশ্যই স্কুলে চুল ছোট করে কেটে যাওয়ার নিয়ম। কিন্তু তাই বলে পরীক্ষা চলার সময় কাটতে হবে। তাকে শাস্তি বা শিক্ষা দেওয়ার আরো অনেক সময় রয়েছে। প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন কাজল পরীক্ষার হলে সবার সামনে সেই ছাত্রটির চুল কেটে দেন। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল ছাত্রটি। অপদস্থ করার মধ্যে শিক্ষক কি আনন্দ পেলেন, আর পরীক্ষার সময় সেই শিক্ষার্থীকে কেন নির্যাতন করা হলো।

অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যার ঘটনাটি মনে আছে! এই তো গেল বছরের ডিসেম্বরের ঘটনা। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ছাত্রী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। প্রশ্নের আঙুল ওঠে শিক্ষকসমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি। গ্রেফতার হন শিক্ষিকা। তিনজন সাময়িক বরখাস্ত হন। কিন্তু এসব বিচার ও দাবি পূরণ ছাপিয়ে কোথাও কি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানবিক সম্পর্কের বিষয়টির কথা কেউ বলছে। মন্ত্রী, শিক্ষক এবং প্রশাসন কেউই কী বোঝার চেষ্টা করছেন। এসব ঘটনা ঘটতেই থাকবে, যদি শিক্ষাকেন্দ্রে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক বন্ধুর মতো না হয়।

শিক্ষকদের মতো আমাদের অভিভাবক অথবা মা-বাবার সঙ্গেও সন্তানদের সম্পর্ক বন্ধুর মতো না। একজন ছাত্রের ভালো লেখাপড়ার পেছনে তার শিক্ষক ও অভিভাবকের গুরুত্ব সমান। তাদের সঙ্গে সম্পর্কটাও সহজ হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক মোটেও সহজ নয়। একটি ভুল করার পর শিক্ষক বা অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করার মতো সম্পর্ক কয়টি পরিবারে রয়েছে। তাই, আমাদের শিশু-কিশোররা নিজেদের ভেতরে গুমড়ে মরে। ছেলেমেয়েদের বেড়ে ওঠার সময়টা এমন যে, যত দিন যায় তারা নতুন নতুন জিনিসের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। মুখোমুখি হয় নতুন নতুন পরিস্থিতির। টিনএজ বয়সে খুব আবেগপ্রবণ থাকে ছেলেমেয়েরা। তাই তাদের মন বুঝে কথা বলতে হয়। কোনো কিছু শেখাতে হলেও হুকুম বা বাধ্য না করে বন্ধুর মতো বোঝাতে হয়। কিন্তু আমরা কি তা করি!

এটাও ঠিক যে, আমাদের বেসরকারি স্কুল কলেজে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতিও স্বচ্ছ নয়। শিক্ষকদের মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ দিয়ে কলেজে চাকরি পেতে হয়। এ নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও যুক্ত থাকেন এ ধরনের খবরও প্রকাশিত হয় সংবাদপত্রে। এসব যখন হয় তখন সেই শিক্ষক স্বাভাবিকভাবেই সবার কাছে সম্মান হারান। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ায় তার নিজেরও নীতি বলে কিছু থাকে না। সুতরাং, ক্লাসে সেই শিক্ষক-ছাত্রদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে যে ভালো কোনো শিক্ষা দিতে পারেন না— এটা বুঝতে কষ্ট হয় না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সম্পর্ক হবে বন্ধুর মতো। প্রত্যেক শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের ক্লাসের বাইরে কিংবা একাডেমিক কাজ ছাড়াও কথা বলার সময় দিতে হবে। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের সময় দেন তা হলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ায় ভালো হয়ে উঠবে। শিক্ষার্থীদের কাছে শিক্ষকরা শুধু শিক্ষক নয় অনেকটা গাইড, ফিলোসফারের মতো। কেননা, বাংলাদেশের বাস্তবতায় সব শিক্ষার্থী শিক্ষিত পরিবার থেকে আসে না। তাদের কাছে শিক্ষকরাই হন সবচেয়ে কাছের মানুষ।

এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল এক লেখায় উল্লেখ করেছেন, কেউ কি জানে না যদি এই শিশু-কিশোরদের গভীর মমতা দিয়ে ভালোবাসা যায়, তাহলে শুধুমাত্র ভালোবাসার মানুষটি যেন মনে কষ্ট না পায় সেজন্য তারা কখনো কোনো অন্যায় করে না? কেউ কি জানে না এই বয়সটি কী অসম্ভব স্পর্শকাতর একটি বয়স? কেউ কি জানে না অপমানের জ্বালা কতো তীব্র? কেউ কি জানে না পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ ব্যবহার করেও একটি হারিয়ে যাওয়া প্রাণকে ফিরিয়ে আনা যায় না?

বিশ ত্রিশ বা পঞ্চাশ বছর আগেও শিক্ষক শিক্ষার্থীর সম্পর্ক ছিল গুরু শিষ্যের। শিষ্য যে ভক্তি নিয়ে গুরুকে সমীহ করতেন শিক্ষকরাও সেই মর্যাদাকে ধরে রাখতে নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার মতন করেই পড়াশোনা করতেন আদর্শবান হতেন। আধুনিক সময়ে বলা হচ্ছে শিক্ষক হবে বন্ধুর মতো। শিক্ষক সেই সমীহ করবার স্থান কী আগের তুলনায় অনেকটাই হারিয়ে ফেলেন নি! যদি ফেলেই থাকেন তার কারণ কি?

উত্তরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের কারণে এমনটা ঘটছে। শিক্ষা জ্ঞান আহরণের বিষয় আর নেই। শিক্ষা হয়ে গেছে ভালো চাকরি পাওয়ার সিঁড়ি। আমাদের শিক্ষকরাই স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব শেখাচ্ছেন। বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে বলেই একই শিক্ষকের ক্লাস করে এসে তার কাছেই প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা যখন থেকে বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে তখন থেকেই শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। শিক্ষা এখন সনদমুখী। চাকরি পাওয়া ছাড়া এখন শিক্ষার আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। শিক্ষা বাণিজ্য ও সনদমুখী হওয়ায় নামি দামি স্কুলগুলো এই ভর্তি-বাণিজ্য শুরু করেছে। আর একইসঙ্গে শুরু হয়েছে কোচিং বাণিজ্য। এতে অভিভাবক আর শিক্ষার্থীরা জিম্মি। কেননা, একজন শিক্ষার্থীকে টিসি দিলে সেই সিটে কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে আরেকজনকে ভর্তি করানো যাবে। তিনি বলেন, এ অবস্থা বদলাতে শিক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষা পদ্ধতি বদলাতে হবে। ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার বদলে সাপ্তাহিকভাবে ক্লাস টেস্টের মতো সৃজনশীল পরীক্ষা নিতে হবে। বছর শেষের পরীক্ষার চাপ দেওয়া বন্ধ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থা বদলে দেওয়ায় জাপানে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মাত্রা কমে এসেছে। শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াও এখন সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থায় চলে যাচ্ছে।

 

সূত্রঃ ইত্তেফাক