আমরা প্রত্যেকেই অসাধারণ : ডেং থিয়াক আডট

প্রথমেই আমি কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের প্রতি, যাঁরা ঐতিহাসিকভাবে এই অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা, যাঁরা অতীতে এ অঞ্চলে ছিলেন এবং এখনো আছেন। এবারের অস্ট্রেলিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’ আমাদের সবার জন্যই একটু বিশেষভাবে অর্থবহ। প্রকৃতপক্ষে ‘ভয় কী’ কিংবা ‘ভয়ের আলাদা অর্থ কী’ তা জানার মধ্য দিয়ে শুরু হচ্ছে আমাদের নতুন বছর ২০১৬।

এ প্রসঙ্গে আমার জীবনের গল্প ভাগাভাগি করে নেব আপনাদের সঙ্গে। দক্ষিণ সুদানের এক ছোট্ট জেলেপল্লি মালেকে আমার জন্ম। আমার বাবা ছিলেন জেলে। আমাদের একটি কলার বাগান ছিল। বাবা থিয়াক আডট গারাং ও মা অথিও অকাও ডেংয়ের আট ছেলেপুলের মধ্যে আমি ছিলাম অষ্টম। সংগত কারণে আমার নামের সঙ্গে মা-বাবা দুজনই জুড়ে আছেন। ডেং শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘বৃষ্টির দেবতা’! আমার একটি ডাকনামও আছে—‘অলোচ’, যার অর্থ সোয়ালো পাখি।

কিন্তু আফসোস! আমি কখনো উড়তে পারিনি। যে বালক বয়সে আমার উড়ে বেড়ানোর কথা ছিল, সেই বয়সে আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। সেনারা যখন আমার গ্রাম থেকে, আমার পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে আমাকে নিয়ে আসে, তখন অবশ্য বুঝতে পারিনি কী স্বাধীনতা আমি হারালাম।

বয়স কম ছিল, তাই সবখানে বঞ্চিত হতে শুরু করলাম। প্রথমেই হারালাম পড়ার এবং লেখার অধিকার। একই সঙ্গে হারালাম শিশু হিসেবে বেড়ে ওঠার অধিকার এবং গান গাওয়ার অধিকার। এর বদলে আমাকে শিখতে হলো যুদ্ধের গান। আমাকে শিখতে হলো কীভাবে মৃত্যুকে ভালোবাসতে হয় সেই বিদ্যা। এমনকি, আমি কী শিখছি তা বলার অধিকারও হারিয়ে ফেললাম। আমার ছিল না কোনো বাক্স্বাধীনতা। আমি তখন প্রাণপণে অপেক্ষা করছিলাম অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য। কারণ, তত দিনে জেনে গেছি, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক হলে আমার কিছু না-কিছু অধিকার অর্জিত হবে।

এখন একজন অস্ট্রেলীয় হিসেবে আমি গর্ববোধ করি এ জন্য যে আমাদের একটি জাতীয় সংগীত আছে। আমি গর্ববোধ করি এ জন্য যে আমরা একটি স্বাধীন জাতি।

আমি অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলাম একেবারে গণ্ডমূর্খ হিসেবে। ক-অক্ষর গোমাংস এক কিশোর, যে ছিল শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, আমার গায়ের রং কালো। এ নিয়ে আমার অবশ্য কোনো দুঃখবোধ নেই, আমি বরং গর্বিত। কিন্তু সুদানে এই কালো রং নিয়ে আমি বড়জোর প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারতাম; সেখানে আইনজীবী হওয়া ছিল একেবারেই অচিন্তনীয় একটা ব্যাপার।

অস্ট্রেলিয়া তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আমি ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ওপর স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছি এবং উলংগং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছি। অস্ট্রেলিয়া আমাকে শিক্ষিত করেছে। আমি সৌভাগ্যবান।

১৯৮৭ সাল। অস্ট্রেলিয়ার ২০০ বছরপূর্তি উদ্যাপনের আগের বছর, আমাকে ইথিওপিয়ায় পাঠানো হয়েছিল। ঠিক কী কারণে আমি জানি না। শুধু মনে আছে, সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছিলাম। তাদের পরিবারের সঙ্গে জুতো ছাড়াই হাজার মাইল পথ হেঁটেছিলাম।

আমি দেখেছিলাম আমার মতোই অনেক শিশু মারা যাচ্ছে। আমি আজও স্মরণ করতে পারি, সেই মৃত মুখগুলো। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার এক ভাইপোর শুকনো কঙ্কাল শরীর, যাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল ভুট্টার বস্তার ওপর! আমি যুদ্ধের সময় দেখেছি, কীভাবে আমার বন্ধুরা মৃতদেহের ওপর অত্যাচার করেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আদেশ না শোনার জন্য আমাকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। আমি ছিলাম এক শিশুযোদ্ধা। আমার কাছে তাদের চাওয়া ছিল, হয় মরে যাও নতুবা মেরে ফেলো।

বছর খানেকের মধ্যেই আমি অপুষ্টিজনিত রোগে আক্রান্ত হলাম। অবস্থা এতটাই খারাপ হলো যে আমি প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। ওই দিনগুলোতে আমার প্রয়োজন ছিল মা-বাবার ভালোবাসা আর নিবিড় পরিচর্যা। তার পরিবর্তে আমাকে দেখতে হয়েছে রক্তে মাখামাখি লাশ আর লাশ।

১৯৯৩ সাল অবধি আমি দেখেছি ১০-১২ বছর বয়সী শিশুদের, যারা কাঁধে করে একে ৪৭ বন্দুক বয়ে বেড়াচ্ছে। তারা তাদের মাথার ওপর বন্দুকটি রাখে আর আঙুল রাখে ট্রিগারের ওপর! কী ভয়ংকর দৃশ্য! অথচ ওই আঙুলগুলোই হয়তো বাজাতে পারত কোনো বাদ্যযন্ত্র কিংবা করতে পারত কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার।

এসব দেখে দেখে আমি ভাবতাম, একটি বন্দুক তুলে নিয়ে যদি নিজের দিকে ট্রিগার চাপতে পারতাম! কিন্তু সাহস হতো না। কখনো নিজের দিকে বন্দুক তাক করে ট্রিগার চাপতে পারিনি। হ্যাঁ, ভয় আমার জীবন বাঁচিয়েছে। এখন আমি জানি, আমার সে সময়ের সহযোদ্ধাদের কাছে বন্দুকের ট্রিগার চাপাই ছিল মরে যাওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায়। বেঁচে থাকার বাস্তবতার চেয়ে মৃত্যুই তাদের কাছে ভালো মনে হয়েছিল।

আজ প্রায় ১৮ বছর পর আমি একজন সফল আইনজীবী। মাঝে মাঝে ভাবি, আমার এই সাফল্য যদি আমার সহযোদ্ধাদের দেখাতে পারতাম, কী দারুণ অনুপ্রাণিতই না তারা হতো! তাদের জন্য আমার ভেতরে প্রচণ্ড দুঃখবোধ কাজ করে। তাদের কাছে ভয় থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় ছিল মৃত্যু। আমি সৌভাগ্যবান। আপনারাও।

আপনার মনে রাখা প্রয়োজন, আপনার ভয়হীন স্বাধীন জীবনের জন্য আপনার মা-বাবা ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আপনার অবশ্যই একটি স্বপ্ন থাকা প্রয়োজন, যে স্বপ্ন আপনার অতীতের ভয়কে দূর করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস দেবে।
আমরা প্রত্যেকেই অসাধারণ। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই আলাদা কোনো না কোনো গুণ রয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই এই জাতির কাছে বিশেষ কিছু। সুতরাং নিজের হৃদয়ের কাছে কান পাতুন, তার কথা শুনুন। তবে হ্যাঁ, একা একা ভয়ের সঙ্গে লড়াই করতে যাবেন না। আপনার কথা বলার স্বাধীনতা রয়েছে। আপনি আপনার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন—সবার সঙ্গে কথা বলুন, প্রয়োজনে তাঁদের সাহায্য নিন।

আমার এক অস্ট্রেলিয়ান বন্ধু ছিল যে আমাকে শিখিয়েছে এই তত্ত্ব। সে আমাকে প্রথম একটি বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিল এবং আমার জন্য একটি চাকরিরও ব্যবস্থা করেছিল। প্রায় এক দশক হয়ে গেল বন্ধুটি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছে কিন্তু তাকে আমি সব সময় স্মরণ করি। সে তার অনুপ্রেরণা আর বিশ্বাস আমার জীবনে সারা জীবনের জন্য গেঁথে দিয়ে গেছে।
ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার সঙ্গী অস্ট্রেলীয়দের, যারা একদিন আমার মতো শরণার্থীদের জন্য অস্ট্রেলিয়ার দরজা খুলে দিয়েছিল। তারা এই সুযোগ না করে দিলে হয়তো আজ আমার বলার মতো একটা গল্প থাকত না।
চলুন, ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। আমার গুরু বলেছিলেন, বাঁচতেই যখন হবে তখন একটি অবিস্মরণীয় বাঁচাই যেন বাঁচি। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম
সূত্র: সিডনি মর্নিং হেরাল্ড

সূত্র: প্রথম আলো