‘অর্ধেক শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না’

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবর্তিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি কার্যকরিতা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘রিসার্চ ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন (রেস)’। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি বিষয়ে বোঝেন না।’

রেস জানিয়েছে, দেশের গ্রামীণ, শহর, সীমান্ত, হাওর এবং পার্বত্য অঞ্চলের ১৬টি জেলার ২১টি স্কুলের ওপর জরিপ চালিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।

 

teacher1ধানমণ্ডির দৃক গ্যালারিতে সোমবার সকাল বেলা ১১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। রিসার্চ ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।

এ সময় বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, নৃবিজ্ঞানী ড. জহির উদ্দিন আহমেদ, বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরী, সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি, ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর আব্দুল্লাহ আল মামুন উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার বাসাউরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রসেন কান্তি তালুকদার এবং ঢাকার ধানমণ্ডির মনেশ্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা স্বপ্না পারভীন উপস্থিত ছিলেন।

‘রিসার্চ ফর এ্যাডভান্সমেন্ট অব কমপ্লিট এডুকেশন (রেস)’-এর সভাপতি অধ্যাপক মো. শরিফ উদ্দিনের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণার সারমর্ম উপস্থাপন করেন ‘রেস’ টিমের সদস্য ফৌজিয়া আক্তার রিনি। এর আগে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর ছয় মিনিটের একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।

প্রতিবেদন নিয়ে মূল্যায়নধর্মী বক্তব্যে সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘বেসরকারি উদ্যোগে এই ধরনের গবেষণা সত্যিই প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আসলে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এই ধরনের গবেষণা নিয়মিত করা। কিন্তু এটা করা হয় না। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় যেসব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়?’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আজ থেকে ৮০ বা ৯০ বছর আগে ভালো ছিল। বই উৎসবের নামে এখন তামাশা করা হচ্ছে। বইয়ের আধিক্য শিক্ষার্থীদের মাঝে ভীতির সঞ্চার করছে। ফলে তারা আনন্দ তো দূরের কথা স্বাভাবিক অবস্থায়ও থাকতে পারে না।’

সৈয়দ আবুল মকসুদ সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির প্রয়োগকে সমালোচনা করে বলেন, ‘সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি সমস্যা নয়, সমস্যা হলো এর প্রয়োগে। শিক্ষার নামে বাণিজ্য একটা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা পদ্ধতির আগে শিক্ষার দর্শন ঠিক করা জরুরি।

অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বইয়ের আধিক্য অস্বাভাবিক। এখনকার শিক্ষার্থীদের যে চাপে রাখা হয় তাতে কেউই সৃজনশীল হতে পারবে না। যদি কোচিংয়েই যেতে হয় তাহলে স্কুলের দরকার কী?’

সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতিটি চালু বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অর্থায়নে কিছু ব্যক্তি কিছু দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিদর্শন করে এসে এটা চালু করেন। কিন্তু যে দেশে ৮০ জন শিক্ষার্থীদের জন্য একজন শিক্ষক, শ্রেণীকক্ষ নেই- সেখানে মাল্টিমিডিয়া দিয়ে খুব একটা লাভ নেই।’ সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির পেছনে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য।

সৃজনশীল পদ্ধতি ভালো না মন্দ সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সেটা নিয়ে মত দেওয়ার পরিবেশ নেই উল্লেখ করে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণে পাসের হারের পেছনে দৌড়ায়। সেই সঙ্গে চলছে ভয়ঙ্কর রকমের শিক্ষা বাণিজ্য। এই প্রবণতা বন্ধ না হলে ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।’

সাংবাদিক মুস্তাফিজ শফি বলেন, ‘সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি শুরুর সময় এটা ভালো মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটার উদ্দেশ্য ভালো ছিল না। এটার পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য জড়িত। আজকের প্রতিবেদনই এখনকার হতাশাজনক অবস্থার প্রমাণ। তবে অল্প পরিসরে গবেষণায় আসল চিত্র পাওয়া যাবে না। আরও ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা দরকার।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পত্রিকাগুলোতেও শিক্ষা পাতায় নোট ছাপছি। এই প্রবণতা বন্ধা হওয়া উচিত। সার্বিক অবস্থার উত্তরণের জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কারণ সরকারকে চাপ না দিলে কাজ করে না।’

বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন শিক্ষা রক্ষা কমিটি করে আন্দোলনে নামা দরকার। একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর যে পরিমাণ বই তাতে তার স্বাভাবিক বিকাশের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।’

 

সূত্র: দ্যা পোর্ট ২৪ ডট কম