বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক শিক্ষা বৃত্তি দেয়ার নামে প্রবঞ্চনা করছে। প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক কর্মকাণ্ডের ব্যয় বাড়িয়ে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে সারা দেশে ব্যাপক প্রচার চলাচ্ছে। এসব প্রচারণায় তারা দাবি করেছে প্রতিষ্ঠানটি গত বছর ১০২ কোটি টাকা শিক্ষা বৃত্তি দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা গেছে, তারা ওই বছর মাত্র ১৭ কোটি টাকা শিক্ষা বৃত্তি খাতে খরচ করেছে। অন্য টাকা খরচ করেছে তাদের নিজস্ব প্রচারের কাজে। যা শিক্ষাবৃত্তি নয়। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ নির্দেশের পর ডাচ্-বাংলা ব্যাংক শিক্ষা বৃত্তির খরচ সংবলিত বড় বড় বিলবোর্ডগুলো সরিয়ে ফেলেছে।
ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কারণে এমনটি হয়েছে। তারা শিক্ষা বৃত্তি ও এর অবকাঠামো নির্মাণের সব খরচ একসঙ্গে যোগ করে ওই হিসাব প্রচার করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু বৃত্তির অংশটি নিয়েছে।জানা গেছে, ব্যাংকটি শিক্ষা বৃত্তি দিতে গিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বড় করে বিশাল বিজ্ঞাপন দিচ্ছে। এছাড়া রাজধানী ও ঢাকার বাইরে দর্শনীয় স্থানে বিশাল বিলবোর্ড দিয়ে শিক্ষা খাতে ১০২ কোটি টাকা বৃত্তি দিয়েছে বলে প্রচার করেছে। যা শিক্ষার্থীসহ দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাংকের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সহায়তা করেছে। শিক্ষা বৃত্তির চেয়ে তার প্রচার কার্যক্রমটিই ছিল বেশি। এছাড়া এ বৃত্তি দেয়ার ক্ষেত্রে ছিল জমকালো আয়োজন। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে দেখা যায়, ওই বছর ব্যাংকটি শিক্ষা খাতে বৃত্তি দিয়েছে মাত্র ১৭ কোটি টাকা। বাকি ৮৫ কোটি টাকা খরচ করেছে এ খাতের বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানির সামাজিক দায়বদ্ধতার (সিএসআর) বাকি টাকা তারা অন্যান্য খাতে খরচ করছে। যা বিধিবহির্ভূত। এ জন্য ডাচ্-বাংলা ব্যাংককে সতর্ক করা হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের সিএসআর ব্যয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা শিক্ষা বৃত্তি দিয়েছে ৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। ২০১৩ সালে তারা সিএসআর খাতে ব্যয় করেছিল ৭৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অথচ প্রচার চালিয়েছে তারা ১০২ কোটি টাকা শিক্ষা বৃত্তি খাতে খরচ করেছে। এছাড়া ব্যাংকটি সিএসআরের খরচের ব্যাপারেও ব্যাপক প্রচার চালিয়ে থাকে।
সিএসআর কর্মসূচির ব্যাপারে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের এ বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। এ বিষয়টি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের একাধিকবার জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চিঠি দিয়ে তাদের সতর্কও করা হয়েছে। একই সঙ্গে অবিলম্বে এ ধরনের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে চিঠিতে অবিলম্বে ব্যাংকের শিক্ষা বৃত্তির বিষয়ে গণমাধ্যম ও বিলবোর্ডে দেয়া তথ্যগুলো সংশোধন করে সঠিকভাবে উপস্থাপন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বিষয়গুলো সংশোধন করে ব্যাংক থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আপনাদের ব্যাংক এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা বৃত্তির যে ব্যবস্থা চালু করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রদত্ত বৃত্তির পরিমাণ সম্পর্কে ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাই আপনাদের শিক্ষা বৃত্তি বিষয়ক বিজ্ঞাপনগুলো দ্রুত সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানানোর জন্য পরামর্শ দেয়া যাচ্ছে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রতি বছর তাদের মুনাফার একটি অংশ থেকে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা বৃত্তি দিয়ে থাকে। এই বৃত্তি প্রদান নিয়ে ব্যাংকের অতিরঞ্জিত প্রচারের ফলে ক্ষুব্ধ হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও অন্য ব্যাংকগুলো সিএসআরের টাকা খরচের নামে দুর্র্নীতি করেছে। এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরাও পড়েছে। সেগুলোর বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে।
ডাচ্-বাংলা ব্যাংক পরিচালন মুনাফা থেকে নিয়মিত ঋণ ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন সংরক্ষণ করে এবং সরকারি কোষাগারে কর দিয়ে ২০১৪ সালে নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ২২০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে ছিল ২০০ কোটি টাকা। মুনাফার এ অর্থ থেকেই তারা সিএসআর কর্মসূচিতে অর্থ খরচ করছে।
সূত্র জানায়, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল, প্রিন্ট মিডিয়া ও বিলবোর্ড প্রচারের জন্য বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এগুলোর একটি অংশও সিএসআর খাত থেকে ব্যয় দেখানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, এসব বিজ্ঞাপন নির্মাণ ব্যয় এবং ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের খরচ আলাদাভাবে পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। পর্ষদের অনুমোদন ব্যতীত এ ধরনের খরচ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর
০৭ জুলাই, ২০১৫