হোম পরীক্ষা চাকুরী উচ্চশিক্ষা

শিক্ষক নিয়োগের ফলাফলে নানা অসংগতি!

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) শিক্ষক নিয়োগের ফলে নানা অসংগতি ধরা পড়েছে। গত ৯ অক্টোবর ১২ হাজার ৬১৯টি পদের জন্য শিক্ষক নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়। তবে এর মধ্যে দুই হাজার ৩৯৩ জনকে একাধিক পদে নির্বাচন করা হয়েছে। এমনকি এক প্রার্থীকে ১০টি পদেও নির্বাচিত করা হয়েছে। আবার এমন প্রার্থীও রয়েছেন, যাঁরা নিবন্ধনে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ নম্বর পেয়ে একাধিক প্রতিষ্ঠানে আবেদনের পর একটি পদেও নির্বাচিত হননি। এ নিয়ে চাকরিপ্রার্থীরা ক্ষুব্ধ। তবে শিক্ষক নির্বাচন ও অসংগতির বিষয়ে এনটিআরসিএ মুখ খুলছে না।

এবার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে ১৪ হাজার ৬৬৯টি শূন্যপদের বিপরীতে ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৭টি আবেদন জমা পড়ে। তবে শেষ পর্যন্ত শিক্ষক নির্বাচন করা হয়েছে ১২ হাজার ৬১৯টি পদে।

প্রকাশিত ফলে দেখা যায়, চট্টগ্রাম জেলার মহসীন আলী ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার নূর মোহাম্মদ ৯ পদের জন্য, ময়মনসিংহের কামরুল হাসান ছয় পদের জন্য, একই জেলার সাবিনা ইয়াসমীন তিন পদের জন্য, বরিশালের ইয়াকুব আলী সাত পদের জন্য, তপন চন্দ্র ও মেহেদী হাসান চারটি করে পদে এবং ঢাকার ওয়াহিদুল ইসলাম ও রাসেল হাছান সাতটি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এভাবে প্রতি জেলা-উপজেলাতেই এক প্রার্থী একাধিক পদে নির্বাচিত হয়েছেন।

খলিল শেখ রাহাত নামের একজন প্রার্থী অভিযোগ করেন, ‘ফলাফল অনুযায়ী একজন প্রার্থী একাধিক জায়গায় মনোনয়ন পেয়েছেন। অথচ আমি ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়ে ২৪টি আবেদন করে একটি প্রতিষ্ঠানেও নির্বাচিত হইনি। দুই হাজার ৩৯৩ জনকে একাধিক পদে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। তাহলে ১২ হাজার ৬১৯টি পদে মোট কতজন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়েছে? একাধিক পদে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কি কেবল দুই হাজার ৩৯৩ জনকেই নির্বাচিত করা হয়েছে? এসব প্রশ্নের বিষয়ে কোনো উত্তরই পাচ্ছি না।’

ভূপেন্দ্রনাথ রায় নামের আরেক প্রার্থী বলেন, ‘আমি দিনাজপুরের পাঁচটি স্কুলে ইংরেজির সহকারী শিক্ষক হিসেবে আবেদন করেছিলাম। আমার ইংরেজি নম্বর ৯০ শতাংশের ওপরে। তা সত্ত্বেও একটি স্কুলেও নির্বাচিত হইনি। এত নম্বর পেয়েও যদি আমি নির্বাচিত না হই, তাহলে কাকে শিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করা হলো?’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষক নিয়োগের আবেদনেও ছিল নানা ফাঁকফোকর। অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হলেও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি পদের জন্য আলাদা আবেদন করতে বলা হয়। এভাবে প্রার্থীদের একাধিক আবেদনে বাধ্য করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এবারের শিক্ষক নিয়োগের আবেদন থেকেই এনটিআরসিএ আয় কয়েছে ২৪ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।

অভিযোগের বিষয়ে গতকাল রবিবার বিকেলে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান এ এম এম আজহার জানান, তিনি ব্যস্ত আছেন। এ মুহূর্তে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারবেন না। পরে এনটিআরসিএর একজন পরিচালককের কাছে একই বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনিও কথা বলতে পারবেন না বলে জানিয়ে দেন।

জানা যায়, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এত দিন শিক্ষক নিয়োগ দিত বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদ বা গভর্নিং বডি। আর এতে একজন শিক্ষককে নিয়োগ পেতে খরচ করতে হতো পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা। তাই সরকার বিধিমালা সংশোধন করে এনটিআরসিএকে শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়। তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে চাহিদা চাইলে ছয় হাজার ৪৭০টি প্রতিষ্ঠান ১৪ হাজার ৬৬৯টি শূন্যপদের তালিকা দেয়। এসব পদের মধ্যে গত ৯ অক্টোবর ১২ হাজার ৬১৯টি পদের জন্য প্রার্থী নির্বাচিত করে এনটিআরসিএ। তাদের মধ্যেই দুই হাজার ৩৯৩ জনকে একাধিক পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। তিন-চার পদে নির্বাচিত হয়েছে—এমন প্রার্থীর সংখ্যা অসংখ্য। নির্বাচিত প্রার্থীরা তাদের প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়ার পর ফের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষক নিয়োগের চাহিদা দিয়েছে মাত্র ছয় হাজার ৪৭০টি প্রতিষ্ঠান। অথচ দেশের প্রায় ২৮ হাজার এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এনটিআরসিএ শিক্ষক নির্বাচনের পুরো দায়িত্ব নিলেও শূন্যপদ খুঁজে বের করতে গাফিলতির পরিচয় দিয়েছে।

সূত্র জানায়, প্রথম থেকে একাদশ নিবন্ধন পর্যন্ত ফলে কোনো মেধা তালিকা প্রকাশ করেনি এনটিআরসিএ। কিন্তু দ্বাদশ নিবন্ধনে উপজেলাভিত্তিক মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়। প্রতি উপজেলায় প্রতি বিষয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া প্রার্থীকেই একাধিক পদে নির্বাচিত করা হয়েছে। সে হিসেবে এখন নির্বাচিত দুই হাজার ৩৯৩ জন তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠান বেছে নেওয়ার পর ফের যদি বর্তমান প্রক্রিয়ায়ই শিক্ষক নির্বাচন করা হয়, তাহলে বাকি পদেও একজনকে একাধিক পদে নির্বাচিত করতে হবে। এভাবে কয়েক দফায় প্রার্থী নির্বাচনের প্রয়োজন হবে। আর প্রতিটি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় দুই-তিন মাস সময় লাগলে এবারের শিক্ষক নিয়োগ শেষ করতেই এক থেকে দেড় বছর লেগে যাবে। অথচ শিক্ষক নিবন্ধনের সনদের মেয়াদ মাত্র তিন বছর।

এনটিআরসিএ সূত্র জানায়, আগামী দিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন্যপদের সংখ্যা হিসাব করেই ত্রয়োদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় প্রায় সমানসংখ্যক প্রার্থীকে উত্তীর্ণ করানো হবে। ফলে বর্তমান নিয়োগেই যদি এক-দেড় বছর লেগে যায়, তাহলে এ নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ত্রয়োদশ নিবন্ধনের ফল প্রকাশ হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমান প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপে শিক্ষক নির্বাচনে প্রথম থেকে দ্বাদশ নিবন্ধনে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের চাকরি পাওয়ার সুযোগ একেবারেই কমে যাবে।

সূত্র: কালেরকন্ঠ ১৮ অক্টোবর, ২০১৬।