অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘মেধার মূল্যায়ন’ করল সচিব কমিটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য আরেকটি বেতন কাঠামোর প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য গত ৪ নভেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে পাঠিয়েছে সচিব কমিটি। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য অভিন্ন বেতন কাঠামোর প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
প্রস্তাবিত কাঠামোতে জাতীয় বেতন স্কেলের তুলনায় এসব ব্যাংকারের বেতন-ভাতা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এমনকি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত জানুয়ারি মাসে নিজেই একটি বেতন কাঠামো তৈরি করে সচিব কমিটিতে পাঠিয়েছিলেন, সেই কাঠামোর চেয়েও বাড়তি বেতন-ভাতার প্রস্তাব করেছেন সচিব কমিটি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য দুটি বেতন কাঠামো করা হলেও কার্যত এ দুটি কাঠামোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সমপদমর্যাদার বেতন-ভাতার পরিমাণ সমান প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বেতন কাঠামো অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপকের বেতন-ভাতা সমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরের ধাপগুলোর বেতন-ভাতাতেও মিল রেখেছে সচিব কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা কাঠামোর প্রয়োজনীয়তার যুক্তি হিসেবে সচিব কমিটি বলেছে, ‘মেধার মূল্যায়ন ছাড়া বিশ্বায়নের এ প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক বাজারে ব্যাংকিং খাতকে সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকে দক্ষ কর্মকর্তা আকৃষ্ট করার জন্য সামঞ্জস্যপূর্ণ বেতন ও সুযোগ সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। তবে এর সঙ্গে অন্যান্য সরকারি ও রাষ্ট্র মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন স্কেলের সামঞ্জস্য থাকা প্রয়োজন।’ প্রথমে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য একটি এবং সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের জন্য অভিন্ন আরেকটি বেতন কাঠামো প্রণয়নের সিদ্ধান্ত ছিল সরকারের। তবে সচিব কমিটি এ তিনটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের সঙ্গে রূপালী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও একই ধরনের সুবিধা দেওয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। অর্থমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সার-সংক্ষেপে কমিটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন কাঠামোর বাইরে আর কোন কোন ধরনের সুবিধা ভোগ করবেন, তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতীয় বেতন স্কেল ২০০৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে বর্তমানে ১৯টি স্কেল বিদ্যমান। প্রস্তাবিত কাঠামোতে উভয় ক্ষেত্রেই এ ১৯টি স্কেলকে ১১টি স্কেলে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র বেতন স্কেলে জাতীয় বেতন স্কেলের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে; ১১, ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে; ১৫ ও ১৬ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে এবং ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে একীভূত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
আর সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের জন্য প্রস্তাবিত অভিন্ন বেতন কাঠামোতে জাতীয় বেতন স্কেলের ৬, ৭ ও ৮ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে; ১০ ও ১১ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে; ১২, ১৩ ও ১৪ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে, ১৫ ও ১৬ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে এবং ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর গ্রেডকে একটি গ্রেডে একীভূত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
যেসব গ্রেডকে একটি গ্রেডে একীভূত করার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেসব একাধিক গ্রেডের বিপরীতে একটি ইনক্রিমেন্ট প্রস্তাব করা হয়েছে। সেসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান নূ্যনতম স্কেল থেকে উচ্চতর স্কেলে যাঁরা বেতন পান, তাঁরা প্রতি উচ্চতর স্কেলের জন্য একটি করে ইনক্রিমেন্ট বেশি পেতে পারেন। যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদ্যমান ৬ নম্বর গ্রেডের সহকারী পরিচালক (সিলেকশন গ্রেড) দুটি, ৭ নম্বর গ্রেডের অফিসার (টাইম স্কেলপ্রাপ্ত) ৮ নম্বর গ্রেডের সহকারী পরিচালকের সঙ্গে প্রস্তাবিত একই গ্রেডে একীভূত হওয়ার কারণে একটি করে অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্ট পাবেন।
তা সত্ত্বেও কমিটি সুপারিশ করেছে, একীভূত গ্রেডগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অসামঞ্জস্য সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিষয়টি নিষ্পত্তি করবে। তবে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীই যেন বর্তমানের তুলনায় কম বেতন না পান, সে বিষয়টি প্রতিষ্ঠান নিশ্চিত করবে।
শীর্ষপদের বেতন-ভাতা
প্রস্তাবিত কাঠামোতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি), ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং ডেপুটি গভর্নরদের কাঠামো নির্ধারণ করা হয়নি। এ সম্পর্কে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকের এমডি কেইস বাই কেইস চুক্তিভিত্তিক নির্ধারিত বেতন আহরণ করে থাকেন। কিন্তু রূপালী ব্যাংকের এমডি নির্ধারিত ৪০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। এ চারটি ব্যাংকের এমডিদের বেতন-ভাতায় সমতা আনা দরকার।
বর্তমানে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের ডিএমডিরা ৩৩৫০০-১২০০x৫-৩৯৫০০ স্কেলে বেতন পেয়ে থাকেন। প্রস্তাবিত অভিন্ন বেতন কাঠামো বিবেচনায় রেখে তাঁদের বেতন-ভাতাও নতুন করে নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বর্তমানে ৪১ হাজার টাকা এবং ডেপুটি গভর্নররা বর্তমানে চুক্তি অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক বা অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পর্যন্ত পদের জন্য প্রস্তাবিত স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বিবেচনায় রেখে গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নরদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে সচিব কমিটি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য শর্ত
মূল কাঠামোর বাইরে সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতি কার্যদিবসে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২০০ টাকা হারে লাঞ্চ ভাতা পাবেন। এর বাইরে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আর কোনো ভাতা পাবেন না। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিজস্ব তহবিল হতে আয়কর দিতে হবে। বিদ্যমান যেসব একাধিক পদের বেতন স্কেলের বিপরীতে একটি বেতন স্কেল প্রস্তাব করা হয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান নূ্যনতম স্কেল থেকে উচ্চতর স্কেলে যাঁরা বেতন পান, তাঁরা প্রতি উচ্চতর স্কেলের জন্য একটি করে ইনক্রিমেন্ট বেশি পাবেন। নতুন কাঠামো পেতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে চাকরি পুনর্গঠন ও শর্তাবলি আইন ১৯৭৫-এর আওতাবহির্ভূত করতে হবে। এ জন্য আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণীত স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন করবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের জন্য শর্ত
সব কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতি কার্যদিবসে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক ২০০ টাকা হারে লাঞ্চ ভাতা পাবেন। এর বাইরে আর কোনো ভাতা পাবেন না তাঁরা। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিজস্ব তহবিল থেকে আয়কর পরিশোধ করতে হবে। তবে ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বা তাঁর ওপরের পদের কর্মকর্তারা মোটর গাড়ি বাবদ ব্যাংক রেটে সুদ দিয়ে ২০ লাখ টাকা অগ্রিম পাবেন। গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি ও ড্রাইভারের বেতন বাবদ মাসে ৩০ হাজার টাকা করে পাবেন তাঁরা। ব্যাংকগুলো প্রকৃত মুনাফা অর্জন করলে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উৎসাহ বোনাস পাবেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে মুনাফার ভিত্তিতে উৎসাহ বোনাস দেওয়া যাবে।
রূপালী ব্যাংকের অন্তর্ভুক্তির কারণ
কমিটি বলেছে, ‘কমিটির তৃতীয় সভায় সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকায় প্রস্তাবিত অভিন্ন বেতন কাঠামোতে রূপালী ব্যাংককেও অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। ১৯৭২ সালে ‘বাংলাদেশ ব্যাংকস ন্যাশনালাইজেশন অর্ডার-১৯৭২’-এর মাধ্যমে তৎকালীন বিভিন্ন ব্যাংকের সমন্বয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। শুরুর প্রথম থেকেই ব্যাংক চারটি একই নিয়মে পরিচালিত হয়ে আসছে। শুধু মালিকানার বিষয়টি বাদে চারটি ব্যাংকেরই পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ সব পরিচালক নিয়োগ, জাতীয় বেতন কাঠামোর আওতায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি নির্ধারণ, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে প্রতিবছর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরসহ অন্যান্য বিষয় এ যাবৎ একই নিয়মে হয়ে আসছে। এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোর মালিক হিসেবে সরকারের পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ই নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অন্য তিনটি ব্যাংকের মতো রূপালী ব্যাংকেরও চাকরিবিধি, প্রশাসনিক এবং জনবল কাঠামোতে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।
সূত্র: কালেরকণ্ঠ