বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষায় বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে প্রশ্ন হবে। যাঁরা ইচ্ছুক, তাঁরা উত্তরও দিতে পারবেন ইংরেজিতে। সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে ইংরেজি ভাষার দখল আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাওয়ায় দক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। তাঁদের ইংরেজি ভাষার জ্ঞান কিছুটা সমৃদ্ধ করতে পিএসসি এই উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা যায়।
ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করা পরীক্ষার্থীদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে তাঁদের মূলধারায় নিয়ে আসার সুবিধার্থে এটি একটি ভালো উদ্যোগ বলে অনেকে মনে করেন। আবার কেউ ব্যক্ত করছেন বিরূপ প্রতিক্রিয়া। বিষয়টি স্পর্শকাতর, সন্দেহ নেই। তাই নির্মোহভাবে এটা বিবেচনায় নিতে হবে। প্রসঙ্গত, মোট ২৭টি ক্যাডার নিয়ে বিসিএস গঠিত। তাঁদের সবাইকে বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। সরকারের উপসচিব পর্যায়ে আসতে পারেন সব ক্যাডারের কর্মকর্তারাই। তাঁদের কেউ কেউ পদোন্নতি পেয়ে সচিব পর্যন্ত হন। তাঁদের সবার কর্মক্ষেত্রে ইংরেজি ভাষাজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে।
অন্যদিকে সে ধরনের জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তা হ্রাস পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ বা সরকারি কাজে এখন বিদেশ যাওয়া অনেক বেড়েছে। বিশ্বায়নের এ যুগে বিভিন্ন দেশ কিংবা বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কও নিবিড়তর হচ্ছে। উভয় দিকের আসা-যাওয়া বেড়েছে অনেক। সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ, শিক্ষাসফর, মতবিনিময় বা দর-কষাকষির জন্য যে ভাষাজ্ঞানটি আমাদের দরকার, তা অতি অবশ্যই ইংরেজি। বর্তমানে এটা ভাষার পাশাপাশি প্রযুক্তি বলেও বিবেচিত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন থাকে, ইংরেজিকে এ ধরনের গুরুত্ব দিতে গিয়ে কি আমরা সংবিধান বা কোনো আইন লঙ্ঘন করছি? সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা বলা হয়েছে। আর এটা অর্জন করতে এ জাতি দিয়েছে অনেক চড়া মূল্য। তবে সংবিধান প্রণেতারা অন্য কোনো ভাষা শিক্ষা বা চর্চা থেকে জাতিকে বিরত রাখতে চাননি। ভাষা আন্দোলনের চেতনাও অন্য কোনো ভাষার বিরুদ্ধে ছিল না। ১৯৮৭ সালের বাংলা ভাষা প্রচলন আইনে দাপ্তরিক কাজকর্মে বাংলাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
তবে বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর ব্যত্যয় রয়েছে। আর পিএসসি তো শুধু পরীক্ষা গ্রহণের একটি মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ব্যবহার করতে চাইছে। বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থাটা তো থাকছেই। যাঁরা ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দেবেন, তাঁদেরও ২০০ নম্বরের বাধ্যতামূলক বাংলা পরীক্ষা দিতে হবে। সে প্রশ্নের মান কিন্তু স্নাতক পর্যায়ের। এভাবে ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে কেউ যদি নিয়োগ পান, তবে তিনি বাংলা জ্ঞানহীন একজন কর্মকর্তা, চিকিৎসক, শিক্ষক, কৃষিবিদ বা প্রকৌশলী হবেন না। তা ছাড়া এ সুযোগ দিলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা চাকরি পাবেন না বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরাও বিভ্রান্ত। চাকরির মেধাক্রম তৈরি হবে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে।
ইংরেজি মাধ্যমের পরীক্ষার্থীরা তুলনামূলকভাবে বেশি নম্বর না পেলে মেধাক্রমে আসবেন কীভাবে? আর নম্বর পেতে তো পরীক্ষার মাধ্যম কোনো বিবেচনায় থাকবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে আঙুলে গোনা কয়েকটি ছাড়া সব কটি এ প্রতিযোগিতায় আসবে বলে মনে হয় না। তেমনি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের মানের নয়; বরং দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েকটির মান প্রশ্নবিদ্ধ। সুতরাং, এ প্রতিযোগিতাটি বিশেষ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অন্যায্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে—এমন ভাবার কারণ নেই। তবে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ছেন এমন কিছু ছাত্রছাত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এটা ভূমিকা রাখবে। তবে তাঁদের ভালো বাংলাও জানতে হবে।
পিএসসির এ পদক্ষেপ নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বয়স, যোগ্যতা ও সরাসরি নিয়োগের জন্য পরীক্ষা) বিধিমালার ২১ নম্বর বিধিতে উল্লেখ রয়েছে, ‘কমিশন ভিন্নরূপ নির্দেশনা প্রদান না করিলে একজন প্রার্থী তাহার লিখিত পরীক্ষার উত্তর বাংলা অথবা ইংরেজি যেকোনো একটি ভাষায় প্রদান করিবেন।’ যতটুকু জানা যায়, কিছুদিন আগেও প্রশ্নপত্র বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় হতো। কয়েক বছর আগে ইংরেজিটা উঠে যায়। এখন আবার বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে প্রশ্ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ইংরেজি ভাষায় যাঁরা পড়াশোনা করছেন, তাঁদের বিসিএসে আকর্ষণ করার জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে এবং এ দেশে বিরাজমান শিক্ষাব্যবস্থায় পদক্ষেপটিকে যুগোপযোগী বলতে হবে। এখন তিন বা ততোধিক ধারায় চলছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। কিছু বাংলা মাধ্যমের নামীদামি স্কুলও বোর্ডের সিলেবাসই ইংরেজিতে পড়াচ্ছে। ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিচ্ছে ইংরেজিতে। আর চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজগুলোতে তো বাংলাই নেই। তেমনি নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে। অথচ তাঁরা সবাই মেধাবী। ও লেভেল ও এ লেভেল পড়ছে প্রচুর ছেলেমেয়ে। তাদের সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন।
এ দেশে যাঁরা রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাঁদের অনেকের বংশধরেরা পড়ছে ইংরেজি মাধ্যমে। তেমনি একজন ভাষাসংগ্রামী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, প্রগতিশীল শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর বাংলাদেশের ভাষা পরিস্থিতি নামক প্রবন্ধে ক্ষোভের সঙ্গে লিখেছেন, ‘এক পুরুষ আগে যে মধ্যবিত্ত বাংলা ভাষার জন্যে প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল, এখন আন্তর্জাতিকতার খাতিরে সে নিজের সন্তানদের বাংলা ভাষা থেকে দূরে রাখতে প্রবৃত্ত হল।
আমার সন্তানেরা সবাই বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া শিখেছে, আমার নাতি-নাতনিরা সবাই ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করছে।’ আসলে তো বাস্তবতা পরিবর্তনশীল। সে বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদেরও চলতে হবে। এই ছেলেমেয়েদের সরকারের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার প্রচেষ্টা নেওয়া সংগত হবে। আমাদের রাষ্ট্রীয় চার নীতির একটি সমাজতন্ত্র। বিশ্বজনীন অর্থনীতির সঙ্গে তাল মেলাতে আমরা দলিল থেকে বাদ না দিলেও এর চর্চা করছি না।
এ বিষয়ে একই প্রশাসনিক উত্তরাধিকারের দুটো দেশ ভারত ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গটি আলোচিত হতে পারে। ভারতে সংবিধান প্রণীত হয় ১৯৫০ সালে। বলা ছিল, রাষ্ট্রভাষা হবে হিন্দি। তবে সংবিধান বলবৎ হওয়ার ১৫ বছর পর্যন্ত ইংরেজি চালু থাকবে। ১৯৬৩ সালে ১৫ বছর শব্দটি বিলুপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ হিন্দি ও ইংরেজি যুগপৎ কার্যকর আছে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। আছে হিন্দিসহ ২২টি ভারতীয় সংবিধানস্বীকৃত ভাষা। ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা খুবই কঠিন ও তীব্র প্রতিযোগিতামূলক। সেখানে ইংরেজি এবং একটি ভারতীয় ভাষায় লিখিত পরীক্ষা দিতে হয়। ইংরেজি কিংবা যেকোনো ২২টি ভারতীয় ভাষায় উত্তর দেওয়ার বিধান রয়েছে। তবে সমীক্ষায় দেখা গেছে, ভারতীয় ভাষাগুলোতে পরীক্ষা দিচ্ছেন যথেষ্ট কম পরীক্ষার্থী। সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, সফলদের বেশির ভাগই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের তো জয়জয়কার মেধাতালিকায়। পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা উর্দু।
তবে এখন পর্যন্ত সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা শুধু ইংরেজিতে হয়। অবশ্য সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নির্দেশ দিয়েছেন উর্দুতে সে পরীক্ষা নিতে হবে। সে মর্মে প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তবে ইংরেজি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়েই বহাল থাকবে, এমনটা বলা চলে। পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় অস্থিতিশীলতার জন্য সেখানকার সিভিল সার্ভিস আগের মান কিছুটা হারিয়েছে বটে। তবে তা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান আমাদের চেয়ে অনেক ভালো। আর ভারত ক্রমাগত এর গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এর সুফল ভোগ করছে। গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা ও জাতীয় সংহতির পেছনে তাদের অবদান উল্লেখ করার মতো। প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক সংকটের সময়ে সে দেশের পররাষ্ট্রসচিবের সফরই যথেষ্ট বিবেচিত হয়। তাঁরা ইংরেজি জানেন। জানেন এক বা একাধিক ভারতীয় ভাষা। জনগণের সঙ্গে হিংলিশ বা বাংলিশে কথা বলেন না।
বর্তমান পিএসসির নেওয়া উদ্যোগটি জোরদার হলে প্রশাসনে আসবেন বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষা ভালোভাবে জানা ব্যক্তিরাই। কারা ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দিলেন তার কোনো পৃথক তালিকা ও মানক্রম থাকবে না। মেধাক্রম হবে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে। সরকারি কাজ আইন অনুসারে বাংলাতেই হবে। কিন্তু যেখানে ইংরেজি লেখার বিধান আছে, প্রয়োজন আছে ইংরেজি বলার, সেখানে ঠেকে থাকবেন না। ইংরেজি না জানার দীনতায় নিজেদে গুটিয়ে রাখবেন না। এটা হলে বাংলা ভাষা কিংবা বিশেষ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব কমে যাওয়ার আশঙ্কা নিতান্তই অমূলক। বরং ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জনকারী শ্রেণিটিকে যদি সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারে অংশগ্রহণে অনুপ্রাণিত করা যায়, তাহলে এটার দীনদশা কিছুটা কমবে। পিএসসির উদ্যোগটি সফল হোক—এমনটাই আমরা চাই।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
সূত্র: প্রথম-আলো