যারা ‘কোথাও’ চান্স পাওনি
যারা জিততে পারনি, তাদেরকে বলছি : জিততে পারনি, ভাল কথা। কিন্তু তাই বলে হেরেও যেও না।
আচ্ছা, জেতা কাকে বলে?
আমি যখন চুয়েটে চান্স পেলাম, তখন টপ সাবজেক্ট ছিল কম্পিউটার সায়েন্স। ‘টপ সাবজেক্ট’ মানে, সেই সময়টাতে চলছিল সিএসই’র ক্রেজ। মানে, সিএসই’তে পড়াশোনা করলে ভাল চাকরি পাওয়া যাবে, সবাই এটা ভাবছিল। আমি অ্যাডমিশন টেস্টে ২য় হয়েছিলাম, মানে যারা চুয়েটে চান্স পায়নি, তাদের চোখে (হয়তোবা) ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দৌড়ে আমি যোগ্যতমদের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে। আরও সহজ করে যদি সরলীকরণ করি, আমার হওয়ার কথা ছিল ২য় সেরা ইঞ্জিনিয়ার! এইতো? নাকি?
কিন্তু দেখ, আমি আজকে কী করছি। কেন করছি? আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইনি। আমি চেয়েছিলাম, সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে। জানো তো, যারা ভার্সিটিতে সাহিত্য নিয়ে পড়ে, ওদেরকে সবাই ভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। আর বাবা-মা’রা চান না, উনাদের সন্তান দ্বিতীয় নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠুক। কেন উনারা ওরকম করে ভাবেন? এখনও অনেকে এই ধারণা নিয়ে বসে থাকেন, সাহিত্যে পড়লে পাস করে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারি করা ছাড়া আর কী-ই বা করবে? আর মাস্টাররা তো গরীব, তাই ওরকম মাস্টার হয়ে কী হবে? তার মানে দাঁড়াল এই, আমাদের বাবা-মা’রা আমাদেরকে ‘কিছু একটা’ হিসেবে দেখতে চান। কথা হল, ওই ‘কিছু একটা’ আসলে কী? ওটা হল, আর্থিক সচ্ছলতা আর সামাজিকভাবে স্বীকৃত একটা অবস্থান। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যতটা না পড়াশোনা করতে যাই, তার চাইতে ঢের বেশি যাই পাস করার পর একটা ভাল বেতনের চাকরি জোটাতে। আজকের দিনে Learning= L(Earning)= Love Earning!
মানে, পড়াশোনার উদ্দেশ্য, জ্ঞানার্জন নয়, সম্মানজনকভাবে অর্থোপার্জন। এখন আসি, যারা যেখানে চান্স পেতে চাইছিলে, সেখানে পাওনি, তাদের ক্ষেত্রে এই উদ্দেশ্যটা কতটা সফল হবে? কিছুটা আত্মকথনের মধ্য দিয়ে আমি এর উত্তরটা দেয়ার চেষ্টা করছি।
আমি যখন ইন্টারে চট্টগ্রাম কলেজে পড়তাম, তখন সহজসরল বোকাসোকা পড়ুয়া স্টুডেন্ট হিসেবে আমার সুনাম ছিল। আচ্ছা, পড়ুয়া…… তো, কী পড়তাম? যা পড়তে ভাল লাগত। কী পড়তে ভাল লাগত? অবশ্যই ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথস এসব নয়। এর আগে স্কুলে পড়ার সময় শুনতাম, যারা ভাল স্টুডেন্ট তাদের ম্যাথস ভাললাগা উচিত। মজার না? আমরা এমন একটা সমাজে বড় হই, যেখানে কী ভাললাগা উচিত, এটাও ঠিক করে দেয়া হয়। 3 Idiots মুভির মতো জন্মের পরপরই ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার সিল মেরে দেয়া হয়! ‘ভাললাগা উচিত’ বলে কিছু থাকাই তো উচিত নয়, তাই না? এই যেমন ধর, ‘রবীন্দ্রনাথকে ভাললাগা উচিত’ বলে কিছু নেই; এমনকি রবীন্দ্রনাথকে ভাললাগানোটা যদি ফ্যাশনও হয়, তবুও। সবাইকেই একইভাবে বাঁচতে হবে কেন? যাই হোক, সবার চাপে বল, ফ্যাশনে বল, কিংবা নিজের ইচ্ছাতেই বল, ইন্টারে ওঠার আগেই ম্যাথসকে ভাল লাগিয়ে ফেললাম। পড়ার বইয়ের বাইরের বইটই পড়ার অভ্যেস আগে থেকেই ছিল। ইন্টারে ওঠার পর যখন এটা অনুভব করতে পারছিলাম, আমার সাহিত্য পড়তে ভাল লাগে, ‘ভাল লাগে’ মানে, আসলেই ভাল লাগে, আমি ভাল লাগাইনি, তখন ভাবলাম, সবাই যেভাবে করে সায়েন্স ফিকশন পড়ে এবং ‘ভাল লাগায়’, আমারও তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট হিসেবে ওরকম কিছু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী ভাললাগানো উচিত, কিংবা কিছু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। আমি এর আগে সায়েন্স ফিকশন অতো পড়িনি, বেছে বেছে শুধু ননসায়েন্স ক্লাসিক টেক্সটগুলি পড়তাম। শুরু করলাম পড়া। জোর করে হলেও ভাললাগাতে চাইলাম। কিন্তু দেখলাম, আমার মাথায় যতটা না সায়েন্সের কল্পনা খেলা করে, তার চাইতে বেশি খেলা করে ননসায়েন্সের কল্পনা। Science was a wrong journey for me. কারোর সাথে শেয়ার করলাম না। এর কয়েক বছর আগে এটা নিয়ে একটা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যখন সিক্স কী সেভেনে পড়ি, তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কবিতা লিখতাম। দুটো কবিতার খাতাও ছিল আমার। একদিন মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পর মা অনেক বুঝিয়েশুনিয়ে এই বলে আমার ব্রেইনওয়াশ করে দিলেন যে, পড়াশোনা করার সময়ে কবিতা লেখা খারাপ। সেই কথা মনে করে আমার কল্পনার রাজ্য আমার মধ্যেই লুকিয়ে রাখলাম। জীবনে এই কল্পনার গুরুত্ব অসীম। ভালকিছু পেতে চাইলে কল্পনা করা প্র্যাকটিস করতে হয়।
ইন্টারে পড়ার সময়ে সাহিত্য আর ভাষার গাঁথুনির প্রতি বিশেষভাবে দুর্বল হয়ে পড়লাম। সারাদিনই সাহিত্য নিয়ে পড়ে থাকতাম। আমাদের সময়ে সৃজনশীল পদ্ধতি ছিল না, আমাদেরকে ইংরেজি আর বাংলা গদ্যপদ্য পড়তে হত, বড় বড় প্রশ্নের উত্তর লিখতে হত। আমি নিজেই এটা অনুভব করতে পারতাম, অন্যরা যেখানে একটা ছোটগল্প পড়তেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, সেখানে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা টানা পড়ে একটা উপন্যাস শেষ করে ফেলতে পারি। ইংরেজি আর বাংলা বইয়ের সিলেবাসের আর সিলেবাসের বাইরের সব টেক্সটই পড়ে ফেললাম। একটা ইংরেজি কবিতা পড়ার সময় অন্যদের যেসময়ে ডিকশনারি দেখতে দেখতেই সময় চলে যায়, আমি ওইসময়ে ভেবে ফেলতে পারি, আসলে এখানে লেখক কোন কথাটি বোঝাতে চেয়েছেন, যা তিনি লেখেননি (Parallel meaning)। সারাদিন ইংরেজি আর বাংলা নিয়ে থাকতে থাকতে শব্দের খেলাকে ভালবেসে ফেললাম। আমি জানতাম না যে ডিকশনারি মুখস্থ করা সম্ভব নয়, তাই একদিন বোকার মতন সিদ্ধান্ত নিলাম, ডিকশনারি মুখস্থ করে ফেলব। বঙ্গীয় শব্দকোষ, সাহিত্য সংসদের ইংলিশ-বেঙ্গলি ডিকশনারি, যথাশব্দ, আর চেম্বার্স ডিকশনারি অব সিনোনিমস্ অ্যান্ড অ্যান্টোনিমস্ মুখস্থ করা শুরু করে দিলাম। ডিকশনারি পড়ে পড়ে শেষের বইটিতে যে শব্দটি দেখতাম, নেই, সেটি পেন্সিল দিয়ে লিখে অ্যাড করে দিতাম। চলন্তিকা, সাহিত্য সংসদ আর বাংলা একাডেমীর বাংলা আর ইংরেজি ডিকশনারি, পেঙ্গুইনের বিভিন্ন ধরণের ডিকশনারি সহ কয়েকশ ভাষাসংক্রান্ত বইপত্র কিনে ফেললাম। এসব কিন্তু কাউকেই বলতাম না। ইন্টারে পড়ুয়া একটা ছেলে ওর স্বপ্ন নিয়ে হাসাহাসি সহ্য করতে পারে না। এভাবে করে আমার এক্সগার্লফ্রেন্ড ম্যাথস ছ্যাঁকা খেল নিউ গার্লফ্রেন্ড লিটারেচারের কাছে।
বাংলা কিংবা ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স করছে, এরকম কিছু ভাইয়া আর আপুর কাছ থেকে জেনে নিতে আরম্ভ করলাম, ওদেরকে ভার্সিটিতে কী কী পড়তে হয়। উনারা শুরুতে আমাকে পাত্তা দিতে চাইতেন না, কিন্তু আমি এটা নিয়ে কনফিডেন্ট ছিলাম যে, ভাষা নিয়ে আমার জানাশোনা আমাকে অবজ্ঞা করার মতো নয়। আস্তে আস্তে অনার্সের সাহিত্যের বইপত্র পড়তে শুরু করে দিলাম। চট্টগ্রামের পাবলিক লাইব্রেরিতে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকতাম। (ক্লাস ফাঁকি দেয়ার কারণে ইন্টারে ডিসকলেজিয়েট হয়েছিলাম।) এসব কেউ জানত না। জানলে হয়তো আমাকে বুঝিয়ে বলতো, ওই পাগলামিটা কেন নিরর্থক। আর আমিও হয়তোবা আমার প্যাশন থেকে সরে আসতাম। যে মানুষ তার প্যাশন নিয়ে থাকতে পারে না, সে এমনকিছু করতে পারে না, যেটাকে আলাদা করে চোখে পড়ে।
একজনের কথা এই মুহূর্তে খুব মনে পড়ছে। আমার এক দাদা ইংরেজিতে অনার্স পড়তেন। উনার সাথে খুব গল্প করতাম। উনি আমাকে ডিকশনারি থেকে ইংরেজি শব্দ ধরতেন। (এই খেলাটা অবশ্য আমরা কয়েকজন কলেজফ্রেন্ড মিলেও খেলতাম।) উনার চাইতে গ্রামার আর ভোকাবুলারি বেশি পারতাম বলে উনি আমাকে একইসাথে ঈর্ষা এবং স্নেহ করতেন। মনে আছে, একদিন উনি খুব রাগ করে বলেছিলেন, “তোমার সমস্যাটা কী, বাপ্পি? তোমাকে ফাউলারের ‘মডার্ন ইংলিশ ইউসেজ’ পড়ার বুদ্ধি কে দিয়েছে?” আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “কেন দাদা, পড়লে কী হয়?” “রেজাল্ট খারাপ হবে, বাসায় বকবে।” “ওটা এখনও হচ্ছে না বলেই তো আমাকে বাসায় কিছু বলে না।” উনি আর কিছুই বলেননি সেদিন। আর কিছু বললে হয়তো আমি আর কোনদিনও উনার কাছে যেতাম না। সেসময় আমার কাছে মনে হত, ডক্টর এস সেন কিংবা রামজি লাল উনারা অনেক পণ্ডিত মানুষ। এই দুইজনের গাইডবই ইংরেজি অনার্সের ক্লাসে পড়ানো হত। সরাসরি অরিজিনাল টেক্সট পড়ার মতো বিদ্যে মাথায় ছিল না বলে আমি উনাদের লেখা গাইড বইয়ের মাধ্যমে বেশকিছু ক্লাসিক টেক্সট পড়ে ফেলেছিলাম। আমি কিন্তু ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথসেরও অনেক ওয়ার্ল্ডফেমাস বই কিনেছিলাম। (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে, মাক্স বর্নের অ্যাটমিক ফিজিক্স, গ্লাস্টনের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি, আই এল ফাইনারের অর্গানিক কেমিস্ট্রি, জি এইচ হারডির অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দ্য থিওরি অব নাম্বারস সহ আরও অন্তত একশো প্রামাণ্য বই। এমনকি ইকোনমিক্সেরও ১০-১২টি প্রামাণ্য বই কিনেছিলাম। কেন কিনেছিলাম? না কেনার অস্বস্তি থেকে বাঁচার জন্য।) কিন্তু দেখলাম আমার ভেতরের আমি’র সবচাইতে ভালবাসার সাবজেক্ট হল লিটারেচার। যেকোনো টপিক নিয়ে ননস্টপ কঠিন কঠিন শব্দ আর ভাষার গাঁথুনি দিয়ে লিখতে পারতাম। কঠিন শব্দে বেশি মার্কস আসে, এটাই ছিল সময়ের অলিখিত নিয়ম। সেসময় রাত ১টার আগ পর্যন্ত ‘অকাজের পড়া’ পড়তাম আর এরপর শুরু করতাম ‘কাজের পড়া’। কখনও রেজাল্ট খারাপ হয়নি বলে বাসায় এটা নিয়ে বকত না। মায়ের কাছ থেকে বইকেনার জন্য টাকা চেয়েছি, কিন্তু পাইনি, এরকমটা কখনওই হয়নি।
সেই বোকা আমি এই স্বপ্নে বিভোর ছিলাম যে ইন্টারের পর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করতে যাব। বেছে বেছে দিল্লি কেন? কারণ সেখানে গেলে এস সেন আর রামজি লালের সাথে দেখা হবে, উনারা তো ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ান, উনাদের ক্লাস করতে পারব। খুব ছেলেমানুষি ভাবনা, না? এক নির্বোধ কিশোরের একেবারে একরৈখিক ভাবনা। নির্বোধ কেন? যে ছেলে ইন্টারে সায়েন্সে পড়ে অনার্সে সাহিত্যে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখার ‘অপরাধ’ করে, সে নির্বোধ নয় তো কী? টেস্ট পরীক্ষার পর মারাত্মক টাইফয়েডে আক্রান্ত হলাম। খুব অসুস্থ হয়ে যাওয়ার কারণে টেস্টের পরের ৩-৪ মাস ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারলাম না, অনেক পড়াই ভুলে গেলাম। সবাই বুদ্ধি দিল, “এবার পরীক্ষা দিলে তুমি স্ট্যান্ড করতে পারবে না, পরেরবার পরীক্ষা দাও।” আমাদের সময়ে ‘বোর্ডস্ট্যান্ড’ বলে একটা দারুণ স্বপ্নের ব্যাপার ছিল, কোন একটা শিক্ষাবোর্ডে প্রত্যেক গ্রুপের মেধাতালিকার প্রথম ২০ জনকে ‘স্ট্যান্ড করেছে’ ধরা হত। শুধু আমার মা বলেছিল, “পরীক্ষা দিয়ে দে। তুই যেভাবে পারিস, লিখে দিয়ে আসিস। রেজাল্ট যা হয়, হোক।”
কখনও কখনও এমনকি পুরো পৃথিবীর বাইরে গিয়ে মায়ের কথা শুনলে সেটার শেষটা ভাল হয়। পরীক্ষা দিয়ে দিলাম। স্টার মার্কস পেয়েছিলাম। স্টার মার্কস মানে, ইন টোটাল কমপক্ষে ৭৫০ পেতে হবে। আমাদের সময়ে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে স্টার মার্কস পেয়েছিলাম আমরা ৭০-৮০ জন। (এটা বললাম এই জন্য যে, এখন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কতজন গোল্ডেন এপ্লাস পায়, সেটার সাথে তুলনা করলে স্টার মার্কস পাওয়াটাও কতটা কঠিন ছিল, সেটা বুঝতে সহজ হবে।) সে সময়ে একটা মজার ব্যাপার ঘটেছিল। পরীক্ষার আগে অসুস্থ থাকার কারণে দীর্ঘদিন পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারিনি, রিভিশন দেয়া সম্ভব হয়নি, তাই আগে যা পড়েছিলাম, তার বেশিরভাগই মাথা থেকে ছুটে গিয়েছিল। ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি-ম্যাথসে খুব কম মার্কস পেলাম, গড়ে ৭২.৬০। কিন্তু ইংরেজিতে পেলাম বোর্ড হাইয়েস্ট (১৪০), আর বাংলায় থার্ড বোর্ড হাইয়েস্ট (১৫৬)। এর মানে কী দাঁড়াল? এর মানে হল, পরীক্ষার খাতায় ল্যাংগুয়েজ আর লিটারেচারে আমি বানিয়ে বানিয়ে যা লিখে দিয়ে এসেছিলাম, সেটাই ‘সেরা’ ছিল। তুমি যা ভালভাবে পার, যদি সেটাকে ভালবাস, তবেই সেটাই তোমাকে সেরা করে দেবে।
আমার মামারা ইন্ডিয়াতে থাকেন। সেসময় চিঠি লেখার চল ছিল, বড় সুন্দর সুন্দর কথায় সবাই চিঠি লিখত। একেকটা চিঠি একেকটা হৃদয়। তাঁদেরকে চিঠিতে জিজ্ঞেস করলাম, দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে ইংলিশে পড়তে হলে কী করতে হয়, কত খরচ পড়ে, এরকম আরও কিছু বিষয়। মামারা ধরেই নিলেন, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমার মা-বাবা’কে ফোন করে বললেন, “কীরে, বাপ্পি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে না?” ইঞ্জিনিয়ার হতে না-চাওয়াটাও যে একটা অপরাধ, সেটা ওই বোকাসোকা কিশোর কীভাবে জানবে? সেই অপরাধী কিশোরটি বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারল না। সেবার বুয়েটের জন্য সায়েন্সের সাবজেক্টগুলিতে মিনিমাম রিকোয়ারমেন্ট ছিল গড়ে ৭২.৬৬ আর ওর ছিল ৭২.৬০। এখন তোমরাই বল, ০.০৬ মার্কস একটা ছেলের মেধাকে কতটুকু ডিফাইন করতে পারে? কিন্তু ভুল হোক, ঠিক হোক, এটাই সিস্টেম। আমার বুয়েটে পরীক্ষা দেয়ার কিংবা ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা ছিল না মানে এই নয় যে, আমার বুয়েটে পড়ার যোগ্যতা ছিল না। তুমি তোমার কিংবা তোমার বাবা-মা’র পছন্দের জায়গায় পড়ার সুযোগ নাও পেতে পার, কিন্তু তার মানে, এই নয় যে, সে সময় থেকে ১০ বছর পরে তুমি ওসব জায়গা থেকে পাসকরা বন্ধুদের তুলনায় পিছিয়ে থাকবেই। চুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় ২য় হলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২০তম, লেদারে ৭তম (শেষের দুটোতেই কোনরকমের বিন্দুমাত্রও প্রস্তুতি ছিল না), বুয়েটে তো পরীক্ষাই দিতে পারিনি, আর কোথাও থেকে ফর্ম নিইনি। আমাদের ফ্যামিলিতে কোন ডাক্তার নেই বলে ইন্টারে বায়োলজি নিলে বাবা-মা জোর করে হলেও ডাক্তার বানিয়েই ছাড়বে, এই ভয়ে বাবা-মা’কে ‘স্ট্যাট নিলে স্ট্যান্ড করতে সুবিধা হবে’ টাইপের উল্টাপাল্টা বুঝিয়েটুঝিয়ে ইন্টারে স্ট্যাট নিয়েছিলাম।
বাবা-মা’কে অনেক কান্নাকাটি করে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, আমাকে অন্তত ঢাকা ভার্সিটিতে ইংলিশে পড়তে দিক। দিল না! রাগ করে আমিও চুয়েটে পড়াশোনা করলাম না। সবসময়ই লিটারেচার, ল্যাংগুয়েজ, জিআরই, জিম্যাট নিয়ে পড়ে থাকতাম; টিউশনি করতাম, ব্যবসা করতাম। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লাম, সার্টিফিকেটও পেলাম, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার হলাম না। এখন তুমিই বল, সেরা জায়গায় পড়লেই যে ফিল্ডে পড়াশোনা করছ, সেই ফিল্ডেই সেরা কিছু হয়ে যাবে, এরকমটা কি হবেই হবে? নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখ, তুমি আসলে কী করতে ভালবাস? কী করলে তোমার মধ্যে অতটা ক্লান্তি কাজ করে না? কী নিয়ে ভাবলে আরও ভাবতে ইচ্ছে করে? ননস্টপ কী নিয়ে কাজ করলেও থামতে ইচ্ছে করে না? পৃথিবীর অন্য ১০ জনের মতই তুমিও ইউনিক, তোমার ভাবনাগুলি তোমার মতই, সবাই যা পারে, তোমাকেও তা-ই পারতে হবে, এমন কিছুতেই নয়। গাছে চড়ার পরীক্ষায় বেচারা হাতিটা গাছে চড়তে পারল না বলে গুড ফর নাথিং হয়ে গেল? তুমি নিজের ইন্টিউশনকে জিজ্ঞেস করে দেখ, তুমি এমন কী পার, যা অন্যরা পারে না এবং তোমাকে আলাদা করে চেনাবে। খুব করে সেটার যত্ন নাও। এই যেমন, আমি লিখতে পারতাম, অকাজের পড়া পড়তে পারতাম, বাংলা আর ইংরেজি আমার যেকোনো বন্ধুর চাইতে বেশি পারতাম। আমি শুরুতেই বুঝে গিয়েছিলাম, আমার ভেতর থেকে কে যেন বারবারই বলে দিচ্ছিল, আমি ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্য জন্মাইনি। ওটা আমার জন্য না। সি প্রোগ্রামিং ল্যাংগুয়েজের বালাগুরুস্বামীর বইয়ের printf “Hello World!” ছাড়া আর কোন প্রোগ্রামিং কখনও নিজের বুদ্ধিতে করেছি বলে মনে পড়ে না। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ, আমি কপি-পেস্ট করে পাসকরা অ্যাক্সিডেন্টাল কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার।
তুমি যেখানে যে বিষয় নিয়েই পড় না কেন, সবসময়ই এটা মনে রাখবে, ভার্সিটি হল তোমার জন্য একটা গ্রুমিং গ্রাউন্ড। মেডিক্যাল থেকে পাস করে তোমাকে ডাক্তার হতেই হবে কেন? যদি তুমি ডাক্তারি ভাল না বাস, তবে তুমি দেশকে সবচাইতে ভালভাবে সেবা করতে পারবে সেবা না করার মাধ্যমে। আমি যদি চুয়েট থেকে পাস করার পর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারই হতাম, তবে আমার দিকে আঙুল তুলে সবাই বলাবলি করতো, “দেখ দেখ! চুয়েটের প্রোডাক্ট কী বাজে!!” আমি আমার অপমান সহ্য করতে পারি, কিন্তু আমার মায়ের অপমান কীভাবে সহ্য করব? আমি সেটা হতে দিইনি। হয়তোবা তোমার ফটোগ্রাফি পছন্দ। আমি তোমাকে বলব, Go for it! নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে দাও ওটার পেছনে। দুএকটা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড জিতে দেখিয়ে দাও, Photography is the right girlfriend for you to live the whole life with! সবাই সবকিছু পারে না। তোমার মতো একটা ফটো তুলতে দিলে হয়তো আমি ক্যামেরাই ভেঙে ফেলব, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, I’m good for nothing. It’s just that photography is not my cup of tea.
জীবনে কিছু একটা করতে হলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াশোনা করতে হবে, এটা কোথায় বলা আছে? আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার যখন প্রথমবার জিমে গিয়েছিলেন, তখন খুব রোগাপটকা শুকনা ছিলেন। উনি যখন জিমের ইনস্ট্রাক্টরকে বলেছিলেন, আমি আগামী ৫ বছরের মধ্যেই মিস্টার ওয়ার্ল্ড হতে চাই, তখন ইনস্ট্রাক্টর সহ সেখানকার সবাই হোহো শব্দে হেসে উঠেছিলেন। উনি তখনই সে জিম থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ২য় বার আর কোনদিনও সেখানে যাননি। এরপরেরটা ইতিহাস। একটা সিম্পল রুল শিখিয়ে দিই : যারা তোমাকে বলে, তুমি কিছু করতে পারবে না, তাদের হয় মিশো না, কিংবা তাদের কথা শুনো না; এমনকি তাঁরা তোমার বাবা-মা হলেও! মহাবিশ্ব এক বিচিত্র জায়গা! এখানে Talent আর Achievement এই দুটো বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা ভাল না। যাদেরকে দেখলে মনে হয়, ভাল করবে, অনেকসময়ই শেষ পর্যন্ত তারা ভাল করে না। তাই আমি তোমাদেরকে বলব, তোমার নিজের সম্পর্কে কিংবা তোমার যে বন্ধুটি ভাল একটা জায়গায় চান্স পেয়ে গেছে, ওর সম্পর্কে কিছুই বলার সময় এখনও আসেনি। যেহেতু তুমি ‘কোথাও’ চান্স পাওনি, ‘মহা অপরাধ’ করে ফেলেছ, সেহেতু এ সময়ে পুরো দুনিয়াটাই তোমাকে কথা শোনানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। ‘কোথাও’ মানে কী? কোথাও মানে, এমন একটা ভার্সিটি, যে ভার্সিটির ‘নাম বেচে’ একটা ভাল চাকরি পাওয়া যায়। আরে ভাই, তোমার ভার্সিটির নাম বেচে তোমাকে চলতে হবে কেন? তুমি তোমার নিজের নামেই চলবে। এর জন্য যা যা করা দরকার, প্রয়োজনে নিজের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সেগুলির সবকিছুই করবে। কী? পারবে তো? ইন্টারে না হয় ছোট ছিলে, কিন্তু এখন আর তুমি ছোট নও। তোমার কাজ হল, যে কথাগুলি শুনছ, সে কথাগুলিকে নীরবে হজম করে নিজের মধ্যে প্রচণ্ড জেদ তৈরি করা, আর প্রতিটি মুহূর্তেই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকা। তোমার আশেপাশের কাউকেই তোমার ক্ষমতাকে ডিফাইন করে দিতে দিয়ো না। তোমার ভার্সিটি তোমাকে আসলেই কিছু শেখাতে পারবে না, যদি তুমি নিজে না শেখ। ভার্সিটিটিকে আমার কখনওই Learning factory মনে হয়নি, বরং সবসময়ই Degree factory মনে হয়েছে। অনার্সে পড়ে তুমি যেটা শিখতে পার, সেটা হল, তোমার Proper attitude. পৃথিবীর ইতিহাস উল্টে দেখ, এখানে যাঁদেরকে আমরা সবাই Great বলে জানি, তাঁদের মাত্র ১৫% মানুষ প্রথম জীবনে তথাকথিত ‘মেধাবী’ ছিলেন। বাকি ৮৫%ই তোমার-আমার মতো অমেধাবীদের দলে।
শোনো! আমি চুয়েট থেকে যে সিজিপিএ নিয়ে পাস করেছি, সেটা পাওয়া কিন্তু সহজ নয়। কারণ সেটা পেতে ‘চাইলে’ তোমাকে অনেক চেষ্টা করে পড়াশোনা না করে বসে থাকতে হবে। আমার কী দোষ! I was kept in a place for praying which was not my temple. That’s why, I couldn’t pray. Simple! আমি অনেকগুলি F পেয়েছি। এর মানে, এই নয় যে, আমি অনেকবার ফেল করেছিলাম। I never regretted as I was not born to be a good computer engineer with good academic grades. আমি ২.৭৪ নিয়ে চুয়েট থেকে গ্রাজুয়েশন করেছি। And, I firmly believed, 2.74 was just a number, not what I was, let alone, my life. কথা হল, তুমি কখন মন খারাপ করবে? কখন ধরে নেবে, কিচ্ছু হচ্ছে না কিচ্ছু হচ্ছে না? তখনই, যখন তুমি যা করতে ভালবাস, তা ঠিকভাবে করতে পারছ না। যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি তোমার ভাললাগার কাজটি ঠিকভাবে করে যেতে পারছ, ততক্ষণ পর্যন্ত, তুমি হেরে গেছ—এটা বলার সময় হয়নি। তবে এটা একটু জেনে নিয়ো, যা তোমার করতে ভাল লাগে, তা আসলে কতটুকু কাজের। আমি আবারও বলছি, ভার্সিটি তোমাকে জাস্ট একটা সার্টিফিকেট দেবে, আর কিছুই না! তুমি কী হতে পারবে, কী হতে পারবে না, সেটা তোমার ভার্সিটি বলে দেবে না। তুমি কোথায় পড়ছ, সেটা বড় কথা নয়; তুমি সামনে কোথায় যাচ্ছ, সেখানে যাওয়ার জন্য এখন থেকে তুমি কী করছ, কী করছ না, সেটাই বড় কথা।
আমি এসএসসি পাস করেছিলাম চট্টগ্রামের সবচাইতে বাজে স্কুলগুলির একটি থেকে : চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল। বাজে, এই অর্থে, সেখানে ভাল স্টুডেন্টরা পড়ত না, যারা কোথাও চান্স পেত না, ওরাই পড়ত, স্কুলটার রেজাল্ট অতো ভাল হত না। বাজে স্কুলে পড়েছিলাম বলেই যে বাজে স্কুলের বাজে স্টুডেন্টদের সাথে মিশে ওদের মতই বাজেভাবে পড়াশোনা করে একটা বাজে রেজাল্ট করে বাজে একটা আগামীর দিকে বাজেভাবে যেতে হবে, এমন তো কোন ‘বাজে কথা’ নেই। বরং আমি এটা বলতে গর্ব করি যে, আরও কিছু অ্যালামনাইয়ের মতো আমার জন্যও চট্টগ্রামের সবচাইতে বাজে স্কুলটাকে নিয়ে মন্তব্য করার আগে লোকজনকে অন্তত ১০০বার ভেবে নিতে হয়। তোমাদের বলছি, ভার্সিটি স্টুডেন্টদেরকে বড় করে না, স্টুডেন্টরাই ভার্সিটিকে বড় করে। একটা অ্যাডমিশন টেস্ট হল জাস্ট একটা টিটোয়েন্টি ম্যাচ। ওরকম একটা ম্যাচে যেকোনো কারণেই হোক, একজন টেন্ডুলকার শূন্য রানেই আউট হয়ে যেতেই পারে। কিন্তু এটা দিয়ে তো আর একজন টেন্ডুলকারকে জাজ করা যায় না। হয়তো সেদিনটা ওর ছিল না। আবার এমনও হতে পারে, একজন ৯ নম্বরে নামা ব্যাটসম্যানও মরিয়া হয়ে ব্যাট চালিয়েও ঠিকঠাক বলে লাগিয়ে লাগিয়ে সেঞ্চুরি করে ফেলতে পারে! তাই বলে আর তো সে টেন্ডুলকার হয়ে যায় না।
একজন সৌম্য সরকার হয়তোবা টেন্ডুলকার হবে না, কিন্তু পরবর্তীতে যেন কেউ কেউ সৌম্য সরকার হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে চেষ্টা তো সৌম্য সরকারকে করে যেতে হবে, তাই না? আবার এমনও তো হতে পারে, এভাবে চেষ্টা করতে করতে, ক্রমাগত নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে যেতে একদিন আমাদের সৌম্য ওদের টেন্ডুলকারকেও ছাড়িয়ে যাবে। কে বলতে পারে?!
গুড লাক!!
(সুশান্ত পালের ফেসবুক থেকে নেয়া)