আন্দোলনের পর আন্দোলন, শিক্ষায় অশনিসংকেত

গত ১৫ অক্টোবর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশনে অসুস্থ হয়ে সেখানেই শুয়ে পড়েন রুম্মন বিন ওয়ালী। মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের প্রতিবাদে এবং পুনঃপরীক্ষার দাবিতে তারা অনশন করছিলেন। অসুস্থ হওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিতে চাইলেও তিনি যাননি। এমনকি কোনো স্যালাইন নিতেও তিনি অস্বীকৃতি জানান।

2015_10_19_09_42_24_H14TqQAwUitrNFC9tNOjb2P5xWLaDJ_800xauto

জিজ্ঞেস করলে কাতর অবস্থায় তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘এটাই তো প্রতিবাদের ভাষা। আমাদের বন্ধুদের দলে দলে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে, দেখতে খুব খারাপ লাগে। আমাদের আন্দোলনে সরকার একটুও তাকায়নি ভাবতেই অবাক লাগে।’

গত কয়েকমাস ধরে শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। একদিকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন তাদের মর্যাদা ফিরে পেতে ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে, অন্যদিকে আদর্শ জাতি তৈরির কারিগর হিসেবে বিবেচিত প্রাইমারি স্কুলগুলোতে উড়ছে বেতন-ভাতা নিয়ে অসন্তোষের বিষবাষ্প। আবার প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে আন্দোলন করছে মেডিকেল কলেজে ভর্তিচ্ছুক কিছু শিক্ষার্থী।

কিছুদিন আগেই শিক্ষায় ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। যদিও তাদের আন্দোলন মেনে নিয়ে সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাট আরোপ প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু অন্যান্য আন্দোলনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন নাজুক।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন
অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামোতে নিজেদের অবস্থানের অবনমনের প্রতিবাদে এবং  সিলেকশন গ্রেড ও স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে প্রায় পাঁচমাস ধরে আন্দোলন করছেন দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এ সময়ে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কয়েকদফায় অর্ধদিবস-পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেছেন।

তাদের আন্দোলনের মধ্যেই অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো পাশ করে মন্ত্রিসভা। শিক্ষকরা এর প্রতিবাদ জানালে দাবি বিবেচনার জন্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে সরকার। যদিও অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে কোনো কমিটি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না শিক্ষকরা।

কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষকদের আন্দোলনের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, শিক্ষকরা যদি সচিবদের সমপরিমাণ সুযোগ-সুবিধা চান তাহলে তাদেরকেও সচিবদের মতো ৫৭ বছর বয়সে অবসরে যেতে হবে। জনগণের টাকায় পড়িয়ে তাদের কোনো অধিকার নেই ছেলেমেয়েদের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়ার।

অন্যদিকে, শিক্ষামন্ত্রী কয়েকবার শিক্ষক নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেন। এসব আলোচনায় শিক্ষকদের দাবি বিবেচনা করা হবে বলে বারবার আশ্বাস দেন। সর্বশেষ গত ৬ অক্টোবর বিকেলে সচিবালয়ে শিক্ষকদের সাথে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। শিক্ষক নেতারা মন্ত্রীকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেন। এর মধ্যে দাবি মানা না হলে ১ নভেম্বর থেকে লাগাতার কর্মবিরতিতে যাবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষক নেতারা।

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন আহমেদ বাংলামেইলকে জানান, ‘আমাদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি সরকার দাবি-দাওয়া মেনে না নেয় তাহলে আমরা আরো কঠোর কর্মসূচিতে যাব। আমাদের সম্মানের প্রশ্নে আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেব না।’

তিনি আরো বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের আগে ইশতেহারে অঙ্গীকার করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রণয়ন করবেন। এখন তিনি সেটি অস্বীকার করতে পারবেন না।’

মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুকদের আন্দোলন
শিক্ষাব্যবস্থায় এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত মেডিকেলে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। মেডিকেল ভর্তিপরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ এনে তা বাতিল এবং পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে প্রায় ২৭ দিন ধরে টানা আন্দোলন করেছে কতিপয় শিক্ষার্থী।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর সারাদেশের সকল মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজসমূহের ভর্তিপরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এর পরদিন অর্থাৎ ১৯ সেপ্টেম্বর ফলাফল ঘোষণা করা হয়। ফলাফল ঘোষণার পরপরই একদল শিক্ষার্থী প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ এনে আন্দোলনের ডাক দেয়। টানা ২৭ দিন ধরে তাদের আন্দোলনে পুরো দেশের মানুষের টনক নড়ে যায়। আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন।

তাদের আন্দোলনে একে একে সংহতি প্রকাশ করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহম্মদ, বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মাকসুদ, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, ড. কামাল হোসেনসহ দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও জাতীয় নেতারা।

আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সাথে অংশ নেন তাদের অভিভাবক ও কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। তবে আন্দোলনে দেখা যায়নি ক্ষমতাসীন দলের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে।

আন্দোলনের অংশ হিসেবে সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচির ডাক দেয় আন্দোলনকারীরা। অনশনে কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়লে অনশনের দ্বিতীয় দিন অধ্যাপক আনু মুহম্মদ এসে গণতদন্ত কমিটি গঠনের আশ্বাস দিয়ে অনশন ভেঙে দেন।

এ সময় তিনি বলেন, সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা। তারা যেহেতু করেনি আমরাই গণতদন্ত কমিটি গঠন করব। তদন্ত কমিটির রিপোর্ট অনুসারে আমরা আমাদের পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেব।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন
অষ্টম বেতন কাঠামোয় বিলুপ্ত সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল প্রবর্তনের দাবিতে প্রায় এক মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা। তাদের দাবি মেনে নেওয়া না হলে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার দায় তারা নেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

এছাড়াও বেতন স্কেলে প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১১তম গ্রেডে নির্ধারণ সহ ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক ফেডারেশন। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার সকালে সারাদেশের প্রায় সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শহিদমিনারে একত্র হন। সেখান থেকে তারা তাদের দাবিসমূহ স্মারকলিপি আকারে প্রধানমন্ত্রী বরাবর পেশ করেন।

কলেজের শিক্ষকদের আন্দোলন
ঘোষিত অষ্টম বেতন স্কেলে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল পুনর্বহাল এবং শিক্ষা ক্যাডারের গ্রেডকে একধাপ উন্নীত করার দাবিতে দু’দিনের কর্মবিরতি পালন করেন সরকারি কলেজের শিক্ষকরা। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তারা এ আন্দোলন শুরু করেন। দুই দফায় তারা কর্মবিরতি পালন করেছেন।

নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার পরপরই সরকারি কলেজের শিক্ষকদের আন্দোলনের ডাক দেয় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি। সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় অধ্যাপকদের বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বেতন স্কেল অবনমনের প্রতিবাদে তারা এ আন্দোলনের ডাক দেন। শিক্ষকদের কর্মবিরতি চলাকালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ অনার্স পরীক্ষা স্থগিত ছিল। এ সময় মাস্টার্সসহ বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষাও স্থগিত ছিল।

এ ছাড়াও টাইম স্কেলের দাবিতে গতমাসে আন্দোলন করেছে ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার সুযোগ চেয়ে আন্দোলন করেছে আইবিএতে ভর্তিচ্ছুক কিছু শিক্ষার্থী। শিক্ষাব্যবস্থায় এমন বারবার আন্দোলনে উদ্বিগ্ন দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিক।

শিক্ষাবিদদের উদ্বেগ
শিক্ষাব্যবস্থায় চলমান এসব আন্দোলনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগণ। তারা বলেন, একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা জাতির উন্নয়নের চাবিকাঠি। সেখানেই যদি বিদ্রোহ দেখা দেয় তাহলে দেশের উন্নয়নই কেবল বাধাগ্রস্ত হবে না বরং মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমেদ বাংলামেইলকে বলেন, ‘গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিকল্পিতভাবে অস্বস্তিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কটুক্তির কোনো দরকার ছিল না। মেডিকেলের আন্দোলনকারীদের দিকে সরকারের নজর দেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষকদের মধ্যে একটা অসন্তুষ্টি আছে। সরকারের উচিৎ সেদিকে নজর দেওয়া।

আন্দোলনের জন্যে তিনি সরকারের অনাগ্রহতাকে দায়ী করে বলেন, ‘মেডিকেলের আন্দোলনকে অহেতুক প্রলম্বিত করা হয়েছে। সরকারের উচিত ছিল শুরুতেই তদন্ত করা। একবার-দুইবার নয়, মেডিকেলে অনেকবার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। মেডিকেল শিক্ষার্থীরা মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করবে, তারা সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত না হলে কিভাবে হবে?’

শিক্ষাব্যবস্থায় অস্থিরতার জন্য বড় কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিকে। তিনি বলেন, ‘গোলমালের বড় কারণ যোগ্য ব্যক্তিকে যথাস্থানে না বসানো। শিক্ষক নিয়োগে কমিশন আছে, সেদিকে তাকানো হচ্ছে না। অনুগতদের না দেখে যোগ্য মেধাবীদের দিকে তাকানো উচিৎ।’

দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্যে এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্যে শিক্ষকদের স্বাতন্ত্র্য জরুরি বলে উল্লেখ করেন এই শিক্ষাবিদ। এছাড়াও শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে সুপরিকল্পনা থাকলেই কেবল সবক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে বলে মত দেন তিনি।