কেউ শখের বশে, কেউ স্বাধীন পেশা হিসেবে, কেউ বা সেবামূলক পেশার কারণে বেছে নিচ্ছেন আইন পেশাকে। একসময় আইন বিষয়ে পাস করার পর খুব সহজে বার কাউন্সিলের মেম্বার হয়ে উকিল হওয়া যেত। কিন্তু আজকাল এ পেশা প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে বেশি। বর্তমানে বিসিএস পরীক্ষার আদলে তিন ধাপে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আইনজীবীর সনদ দেওয়া হয়। কিন্তু এ বিষয়টি ভালো করে না জানার কারণে অনেকেরই সমস্যায় পড়তে হয়। তাই আইনজীবী হওয়ার জন্য কী করণীয়, তা নিচে আলোচনা করা হলো।
আইনজীবী হওয়ার জন্য একজন ব্যক্তিকে দুই প্রকার শর্ত পূরণ করতে হবে :
প্রথম শর্ত
১. তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে;
২. ২১ বছর বয়স পূর্ণ করতে হবে;
৩. নিচের যেকোনো একটি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে :
(ক) বাংলাদেশ সীমার মধ্যে অবস্থিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি থাকতে হবে; বা
(খ) বার কাউন্সিল কর্তৃক স্বীকৃত বাংলাদেশের বাইরে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিষয়ে ডিগ্রি থাকতে হবে; অথবা
(গ) তিনি যদি একজন ব্যারিস্টার অ্যাট ল হয়ে থাকেন।
দ্বিতীয় শর্ত
(১) উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ হলে যে কেউ বার কাউন্সিলের একটি ফরম পূরণ করে জমা দিতে পারবেন। সঙ্গে আরো যা দিতে হবে তা হলো—
(ক) আবেদনকারীর জন্মের সনদের সন্তোষজনক সাক্ষ্যপ্রমাণ;
(খ) অনুচ্ছেদ ২৭ অনুযায়ী যোগ্যতার সন্তোষজনক সাক্ষ্যপ্রমাণ;
(গ) আবেদনকারীর চরিত্র ও আচরণ সম্পর্কে ভালো অবস্থানরত দুজন ব্যক্তির প্রশংসাপত্র;
(ঘ) ফরমে উল্লিখিত তথ্য সত্য ও নির্ভুল মর্মে একটি এফিডেফিট প্রদান করতে হবে;
(ঙ) এক হাজার ২০০ টাকা প্রদানের রসিদ দিতে হবে।
(২) অ্যাডভোকেট হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার আগে তাঁকে একজন ১০ বছরের অভিজ্ঞ অ্যাডভোকেটের চেম্বারে ধারাবাহিক ছয় মাস শিক্ষানবিশ কাল অতিক্রম করতে হবে।
পরীক্ষার ধাপগুলো
প্রথমে ছয় মাস শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করবেন—এ মর্মে এমন একজন সিনিয়রের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে হবে। তবে সিনিয়রের কমপক্ষে ১০ বছর নিয়মিত ওকালতি করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তাঁর সঙ্গে থাকবে একটি হলফনামা বা এফিডেভিট। আর থাকবে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুকূলে নির্ধারিত ফির ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার প্রেরণের রসিদ। আইনে স্নাতক পরীক্ষা বা অন্য কোনো ডিগ্রিপ্রাপ্তির পরীক্ষা প্রদানের পরপরই অনতিবিলম্বে উল্লিখিত চুক্তিপত্র, এফিডেভিট ও ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার প্রেরণের রসিদ বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সেক্রেটারি বরাবর পাঠিয়ে দিতে হবে।
আপনার পাঠানো কাগজপত্র বার কাউন্সিল কর্তৃক গৃহীত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যে বার কাউন্সিল আপনার বরাবর একটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড ইস্যু করবে। সেখানে আপনাকে একটা রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেওয়া হবে। ছয় মাস অতিক্রান্ত হলে অ্যাডভোকেট তালিকাভুক্তির পরবর্তী লিখিত পরীক্ষার তারিখ জানিয়ে আপনাকে ওই পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য কিছু কাগজ সংযুক্তি সাপেক্ষে আবেদনপত্র প্রেরণের আহ্বান জানানো হবে।
বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অনুকূলে পরীক্ষার নির্ধারিত ফি বাবদ নির্ধারিত টাকা ব্যাংক ড্রাফট বা পে-অর্ডার বা ব্যাংকে বার কাউন্সিলের অ্যাকাউন্টে নগদ জমা দেওয়ার রসিদ। সিনিয়রের কাছ থেকে শিক্ষানবিশ সমাপন-সংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র। পূর্ণ বিবরণসহ পরীক্ষার্থী ও তার সিনিয়রের স্বাক্ষর, সিলমোহর ও তারিখযুক্ত কমপক্ষে পাঁচটি দেওয়ানি ও পাঁচটি ফৌজদারি মামলার তালিকা, যার শুনানিকালে পরীক্ষার্থী নিজে তাঁর সিনিয়রের সঙ্গে আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এগুলোর সঙ্গে থাকতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার সব সনদ, চারিত্রিক সনদ ও ছবি।
পরীক্ষা পদ্ধতি
আবেদন করা প্রার্থীদের প্রথমেই কুইজ বা এমসিকিউ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া হবে। এরপর ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। এতে পাস নম্বর ৫০। তৃতীয় পর্যায়ে ১০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। বিচারপতিরা এই মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্ন করে থাকেন। মৌখিক পরীক্ষায় জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর অধীনে প্রার্থী যে বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, তা থেকেই প্রশ্ন করা হয়।
পরীক্ষার বিষয়গুলো
ছয়টি বিষয়ের ওপর লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এগুলো হলো ফৌজদারি দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, দেওয়ানি কার্যবিধি, সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, তামাদি ও সাক্ষ্য আইন। প্রতিটি বিষয় থেকে তিনটি প্রশ্ন থাকে এবং একটি উত্তর দিতে হয়।
নিম্ন আদালতে প্র্যাকটিস
মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে আপনি আইনজীবী (নিম্ন আদালতের) হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করলেন। অর্থাৎ আপনি হয়ে গেলেন অ্যাডভোকেট। এ ক্ষেত্রে আপনি পেয়ে যাবেন বার কাউন্সিলের সদস্যপদ। তবে শুধু সনদ পেলেই হবে না, আপনি যে বারে প্র্যাকটিস করতে চান, সেই বারের সদস্যপদও নিতে হবে।
হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিস
নিম্ন আদালতে দুই বছর আইনজীবী হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে হাইকোর্ট বিভাগে আইনজীবী হিসেবে সনদ নেওয়ার যোগ্যতা হয়। তবে হাইকোর্টে ১০ বছরের বেশি প্র্যাকটিস করছেন এমন এক সিনিয়রের সঙ্গে শিক্ষানবিশ চুক্তি করতে হয়। আর যদি বার অ্যাট ল ডিগ্রি বা এলএলএম পরীক্ষায় কমপক্ষে ৫০ শতাংশ নম্বর থাকে, তখন বার কাউন্সিল থেকে সনদ পাওয়ার পর এক বছর অতিক্রান্ত হলে আপনি পরীক্ষা দিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হলো, সুপ্রিম কোর্টের একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেটের অধীনে আপনাকে এক বছর প্র্যাকটিস করতে হবে এবং এ মর্মে আপনার সিনিয়রের একটা প্রত্যয়নপত্র আবেদনপত্রের সঙ্গে দাখিল করতে হবে।
আপিল বিভাগে প্র্যাকটিস
একজন আইনজীবীর হাইকোর্ট বিভাগে প্র্যাকটিসের বয়স পাঁচ বছর হলে এবং হাইকোর্টের বিচারপতিরা যদি তাঁকে এই মর্মে স্বীকৃতি দেন যে তিনি আপিল বিভাগে ওকালতি করার জন্য সঠিক ও উপযুক্ত ব্যক্তি, তবে কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন সাপেক্ষে এনরোলমেন্ট কমিটি তাঁকে আপিল বিভাগে মামলা পরিচালনার সুযোগ দিয়ে থাকে। তবে কাউকে বিশেষভাবে উপযুক্ত মনে করলে এ আনুষ্ঠানিকতা পালন ছাড়াও প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকরা তাঁকে আপিল বিভাগে প্র্যাকটিসের অনুমতি দিতে পারেন।
সূত্র: এনটিভিবিডি ডট কম