কওমির দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণা!

কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর স্তরের মর্যাদা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ঘোষণা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের একটি সাধারণ ধারার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামীক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান হবে কওমি মাদরাসার দাওয়ায়ে হাদিস ডিগ্রি।

মঙ্গলবার (১১ই এপ্রিল) রাতে গণভবনে বাংলাদেশের ‘কওমি মাদ্রাসার আলেমগণের সঙ্গে সাক্ষাৎকার’ অনুষ্ঠানে এই ঘোষণা দেন সরকার প্রধান।

এই অনুষ্ঠানে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আহমদ শফী, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ আইন পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক মওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদসহ কয়েকশ আলেম উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কওমি মাদ্রাসার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে এবং দারুল উলুম দেওবন্দের মূল নীতি সমুহের উপর ভিত্তি করে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্স (ইসলামিক স্টাডিজ ও আরবি সাহিত্য) সমমান প্রদান করা হল।”

বাংলাদেশে কয়েক ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় কওমি মাদ্রাসার সনদের এই ধরনের স্বীকৃতিতে শিক্ষাবিদ অনেকের বিরোধিতা রয়েছে। জঙ্গিবাদের বিস্তার রোধে মাদ্রাসা শিক্ষা বিলুপ্তির দাবিও রয়েছে।

কওমির সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “এই সম্মানটা পেলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আলোর পথে যাত্রা শুরু করবে, অন্ধকারে থাকবে না। তারা দেশে বিদেশে চাকরি করতে পারবে। তারা বিভিন্ন জায়গায় কাজ পাবে। তাদের জীবনে অনেক সুযোগ আসবে।

“যেহেতু এই শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। তারা কোথাও তেমন কোনো সুযোগ পেত না।”

ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে কওমি মাদ্রাসার যাত্রা শুরু হয়। সারা বাংলাদেশে প্রায় ১৪ হাজার কওমি মাদ্রাসায় প্রায় ১৪ লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে।

ঘোষণার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রাতে সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, ‘এখন নিয়ম-কানুন মেনে এটি করা হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ইহসানুল করিমও বিষয়টি সাংবাদিকদের নিশ্চিত করেছেন।

এর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্রগুলো দৈনিকশিক্ষাডটকমকে জানিয়েছিল সরকারের কোনো প্রতিনিধি ছাড়াই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর করা কমিটির অধীনে পরীক্ষা নিয়ে এই সনদ দেওয়া হবে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষগুলোর চাওয়া অনুযায়ী এই প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। গত ২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় সনদের স্বীকৃতির বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত হয়। যা আজ ১১ই এপ্রিল ঘোষণা দেওয়া হলো।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মো: ছানাউল্লাহ দৈনিকশিক্ষাডটকমকে বলেন, দাওয়ায় হাদিসকে ইসলামী স্টাডিসের সমমান দেয়ার বিষয়ে ইতিপূর্বে কোনো আলোচনা হয়েছে মর্মে আমার জানা নেই।

জানা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিগত সরকারের শেষ দিকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রস্তাবিত এই কর্তৃপক্ষ গঠন করার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধি রাখার কথা ছিল। কর্তৃপক্ষ গঠনের জন্য আইনের খসড়া অর্থ, জনপ্রশাসন ও প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় অনুমোদন শেষে মন্ত্রিসভার বৈঠকেও উত্থাপন করা হয়। কিন্তু খসড়াটি আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ফেরত পাঠানো হয়। মূলত মাদ্রাসাগুলোর সবাই একমত না হওয়ায় এবং রাজনৈতিক কারণে তা পিছিয়ে যায়।

কওমির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: 

কওম আরবি শব্দ। এর অর্থ গোষ্ঠী, গোত্র,জাতি, সম্প্রদায়, জনগণ। কওমি অর্থ হলো গোত্রীয়, জাতীয়, জনগণ সম্পর্কিত। শব্দ দু’টি এই অর্থে ফার্সি এবং উর্দু ভাষাতেও ব্যবহৃত হয়। ‘কওমি মাদ্রাসা’ এর মানে হলো জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জাতীয় বিদ্যাপীঠ।যেহেতু কওমি মাদ্রাসা সাধারণত সরকারি অনুদানের পরিবর্তে পুরোপুরি জনসাধারণের মাধ্যমে পরিচালিত হয় তাই হয়তো এ ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কওমি মাদ্রাসা বলা হয়।

বাংলাদেশে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার প্রাক-প্রাথমিক স্তর শুরু হয় শিশুর চার-পাঁচ বছর বয়স থেকে। সর্বোচ্চ স্তর হলো দাওরায়ে-ই-হাদিস। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা বোর্ড এই স্তরকে সাধারণ শিক্ষার স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমান বলে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সারা দেশে ১৩ হাজার ৯০২টি কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১৪ লাখ। বেশির ভাগ মাদ্রাসাই মফস্বল এলাকায় অবস্থিত।

উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, দারুল উলুম দেওবন্দ  হল ভারতের একটি মাদরাসা। এখান থেকে দেওবন্দি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। উত্তর প্রদেশের শাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে এই মাদ্রাসার অবস্থান। ১৮৬৬ সালে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ইসলামি পণ্ডিত এটির প্রতিষ্ঠা করেন। মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি তাদের প্রধান ছিলেন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা রশিদ আহমেদ গাঙ্গোহি ও হাজি সাইদ আবিদ হুসাইন।

দারুল উলুম দেওবন্দের পণ্ডিতদের একটি বড় অংশ ভারত ভাগ করে দুই রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। মাওলানা হুসাইন আহমেদ মাদানি পাকিস্তান ধারণার বিরোধিতাকারী পণ্ডিতদের অন্যতম ছিলেন। এ সময় তিনি মাদরাসার শায়খুল হাদিস হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং আলেমদের সংগঠন জমিয়ত উলামায়ে হিন্দের নেতৃত্ব দেন। তিনি বলেন, “সবাইকে একটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য প্রয়াস চালাতে হবে যাতে হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিষ্টান ও পারসিরা অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এধরনের স্বাধীনতা ইসলামসম্মত।” দেওবন্দ ধারা ইসলামের প্রাচীন রূপের পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং যেকোনো প্রকার সহিংসতা থেকে নিজেকে দূরে রাখে।